বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা, বসন্ত এসে গেছে

প্রকাশিত: ২২ মার্চ, ২০২৩ ০৩:০৭ (মঙ্গলবার)
বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা, বসন্ত এসে গেছে

sahittoসকালে যখন ঘুম ভাঙলো, আমার শরীর তখন রৌদ্রস্নাত। ঘরের দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে নরম সোনালি রৌদ্রের আভা ছড়িয়ে পড়েছে আমার বিছানায়। পুরো ঘর জুড়ে। গত ক’দিনের মেঘলা, গোমড়ামুখো, কনকনে হাঁড়কাপানো শীত শেষে আজ যেন আকাশ হতে উষ্ণ, তরল সোনা ঝড়ে পড়ছে।

“আজি দখিন-দুয়ার খোলা

এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।”

আজও সকাল হতে না হতেই আমার সেই ‘প্রাণসখা’কেই স্মরণ করতে হল। সেই যে কিশোরি বয়সে এই মানুষটার প্রেমে পড়েছিলাম। আজ অব্দি সেই ঘোর আর কাটলো না। এমনই কঠিন সেই প্রেম! তাকে বাদ দিয়ে আমার একদিনও চলে না। যাইহোক, আমি বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমার বেপর্দা জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। মনে পড়লো আরও একজন ঘোরলাগা মানুষের কথা। শরীরময় দূরারোগ্য ক্যান্সার এবং কেমোথেরাপির যন্ত্রণা সইতে সইতে নিউ ইয়র্কের আকাশ দেখে মুগ্ধ, বিস্মিত হয়েছিলেন মানুষটি। “নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ” নামে লিখেছিলেন একটি আস্ত আত্মজৈবনিক উপন্যাস। নাম না করলেও অনেকেই জেনে গেছেন, নামের আড়ালের সেই মানুষটিকে!

আজ মার্চের একুশ তারিখ। ক্যালেন্ডারের দিন, ক্ষণ, সময় হিসেব করে আজ পয়লা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথমদিন। আমাদের নগরে আজ বসন্ত এসেছে। রবিবাবুর আমলের ভারতবর্ষ থেকে শত সহস্র যোজন দূরে, আটলান্টিকের পাড়ের দেশটিতে বসন্ত আসতে আসতে বেশ খানিকটা দেরী হয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে যখন বসন্ত উৎসব শুরু হয়, আমাদের জনপদ তখন বরফাচ্ছাদিত। আমরা তখন শীতের কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাই।

এত চনমনে দিনে বিছানায় গড়াগড়ি করা সত্যিই দায়। এমন একটা দিন হেলায় হারানো একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, গুটিকতক গাঙ্গচিল এসে আমাদের টেরেসে রোদ পোহাচ্ছে। এদেরই মধ্যে ভাব-গম্ভীর কেউ কেউ আবার একপায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যোগাসন রত। খুব আয়েসিরা টেরেসের সবুজ রঙা কাঠের বেন্চে বসে মাঝেমধ্যে আলগোছে ডানা মেলে দিচ্ছে। পালকের ভাজে ভাজে যেন মেখে নিচ্ছে বাতাসের রোদেলা গন্ধ। রোদের উষ্ণতা আর ঝলমলে আলোয় চলছে তাদের সূর্যস্নান। সামনের দিকে চোখ আরও প্রসারিত করতেই বাড়ির সামনে এলিয়ে থাকা আটলান্টিক সাগর আমায় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকল!

“অলস মেয়ে! এমন রোদেলা দিনে এখনও ঘরে?”

মন মনে যদিও আমি আদি মুণী-ঋষিদের মত তপোবন ভালোবাসি। ইচ্ছে করে খড়ের ছাউনি দেয়া একটি মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে একতারা-দোতারা বাজানোর জীবন পেতে। সেই মাটির ঘরের নিকানো উঠোনটি, তার এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকা লাল রক্তজবার গাছটি আমায় যেন অহর্নিশি টানতে থাকে। কিন্তু নাগরিক জীবন-যাপনের অভ্যস্ততা, বাস্তবতা আমাকে করে তুলেছে দ্বিচারিনী। তাইতো মাটির সোঁদা গন্ধ ভরা আটপৌরে জীবনকে উপেক্ষা করে, আমার ঠাঁই হয়েছে সাগরপাড়ের একটি ষোলতলা হাইরাইজ বিল্ডিং এর দশতলায়। আমার ছোট্ট স্টুডিও ঘরে রয়েছে বড় বড় তিনটে জানালা। তার দূটো পশ্চিমমুখী। অপরটি দক্ষিণমুখী। তবে কোন জানালাই পুরোপুরিভাবে খোলার সুযোগ নেই। সেই সুযোগ নির্মাতারাই বন্ধ করে রেখেছে। জানালাগুলো মাত্র ইঞ্চি চারেকের মত খোলা যায়। জানালা খুলে দিলে, সেই অপরিসর খোলা পথে শো-শো গর্জনে বাতাসের প্রবল ঝাপটায় জানালার পাশে রাখা ফুলদানি, ছবির ফ্রেম সবকিছু পড়ার উপক্রম হয়। তড়িঘড়ি করে জানালায় পুনরায় খিল দিতে হয়। ঝড়-বাদলার দিনেতো কথাই নেই, সুযোগ পেলে গোটা আমাকেও উড়িয়ে নিতে পারে এই দূরন্ত বাতাস! উন্মুক্ত বাতাসকে রুখে দিতেই আগল টানার এই ষড়যন্ত্র!

নাহ! এবার বেরুতেই হবে। সাগর আমায় ডাক দিয়েছে। এই আহ্বান উপেক্ষা করা খুব কঠিন। দ্রুত সকালের প্রাতরাশ শেষ করলাম।মাথায় উলের টুপি, গলায় স্কার্ফ, হাতে দস্তানা আর জ্যাকেট পরে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে।

আজ দেখছি সাগরকন্যা বড় উন্মাতাল। সাগর বড় অদ্ভুত। এর চরিত্র বোঝা ভার। অজানা, অচেনা, দূর্ভেদ্য এবং অগম্য বলেই সে এত রহস্যময়! খুব কাছ থেকে যতই দেখছি; ততই বিস্মিত হচ্ছি। একেকদিন তার একেক রূপ। কখনও দেখি সে খুব শান্ত। পুকুরের মত টলটলে জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলে দুলছে বিশাল জলাধার। যেন গালে টোল ফেলে হাসছে সাগরকন্যা! খুব মিষ্টি সেই সৌন্দর্য! আবার কখনও সে তীব্র যৌবনাবেগে উত্তাল। আবার কখনও ক্ষুদ্ধ, প্রলয়মত্ত, বিধ্বংসী। মুহূর্তেই রাক্ষুসী রূপ ধরে সমস্ত চরাচর গ্রাস করে নিতে পারে এই কোমল জলরাশি! সাগরের সাথে আমাদের সখ্যতাও তাই খুব অদ্ভুত। তাকে ভালোবেসে খুব বেশী জাপটে ধরে কাছে টানা যায় না। আবার অবহেলায় দূরে ঠেলাও সম্ভব হয় না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জল থেকে উঠে এসেছিলেন বলেই হয়তো এই নাড়ির টান। এই অমোঘ আকর্ষণ। “যেন কঠিনেরে ভালোবাসিলাম!” আবার তাকেই স্মরণ; সেই রবীন্দ্রনাথ!

কিন্তু আজকের এমন ঝলমলে সূর্যদিনে সাগরকন্যা এমন ফুঁসছে কেন?ভাবতে ভাবতে, পিয়ারের কাঠের পাটাতন ধরে হাঁটতে লাগলাম। তীর থেকে জলের একটু গভীরে যেতেই টের পেলাম সাগরের বুক ভর্তি থৈ-থৈ জলের প্রবল আন্দোলন!  বড়-বড় ঠেঁউগুলো যেন গভীর আবেগে অতল থেকে ফুলে-ফুলে উঠছে। বোঝা গেল আজকের বসন্ত বাতাসের পরশেই সাগরকন্যা এমন উতলা। সে এমন প্রেমমত্ত। তার বুক জুড়ে তাই তাথৈ নিত্য!

বাতাসের ঝাপটা এড়াতে ফিরে এলাম বোর্ডওয়াকে। বোর্ডওয়াক ধরে উদিত সূর্যের দিকে মুখ করে, পূর্বদিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রাইটন বিচে। তাতিয়ানা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে একটু দাঁড়াতে হল। নাহ! আজ আর কাপড়চোপড়ের এত বাহুল্যের প্রয়োজন নেই। শীতের প্রকোপ খুবই কম। বরং একধরনের আরামদায়ক ঠান্ডা। মাথার টুপি, স্কার্ভ খুলে পকেটে রাখলাম। জ্যাকেটের বোতাম খুলে দিলাম। বোর্ডওয়াকের পাশে কাঠের একটি বেঞ্চে বসে আছে আলেকজান্ড্রা। তার ক’জন প্রতিবেশীর সাথে সূর্যস্নান করছে। এইদিকটা রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় নারী-পুরুষ এবং শিশুদের পদচারনায় সর্বদাই মুখরিত। এখানকার আবাসিক হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর অধিবাসীরাই এই এলাকাকে জনাকীর্ণ করে রাখে। তাই শীতকালে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেলেও সাগরতীর কখনও জনশূন্য হয় না। ঠান্ডা উপেক্ষা করে বর্ষিয়ানরদেরও বোর্ডওয়াকে অবসর সময় কাটাতে দেখা যায়। কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে, কেউ ওয়াকার নিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন। কেউ রোদ্দুরে পিঠ ঠেঁকিয়ে মনোযোগ দিয়ে বই পড়েন। কেউ প্রতিবেশী বন্ধুর সাথে গল্পে মেতে ওঠেন।  কেউবা কানে এয়ারফোন লাগিয়ে দুরালাপে ব্যস্ত।

ব্রাইটনে রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় অভিবাসীদেরই আধিপত্য বেশী। তারা নিজেদের লোকেদের সাথে কথা বলে তাদের নিজস্ব আন্চলিক ভাষায়। কেবল প্রয়োজনে ইংরেজি বলে। হঠাৎ করে দেখলে রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয়দের মধ্যে তফাত করা কঠিন। আমার চোখে তারা একইরকম দেখতে। ভাষার পার্থক্য ধরাও কঠিন। উভয় দেশের অধিকাংশ নারীরাই স্বর্ণকেশী, নীলনয়না। খুব লক্ষ্য করলে তফাতটুকু চোখে পড়ে। রাশিয়ানরা একটু ফ্যাকাশে সাদা এবং ইউক্রেনীয়রা বাদামী সাদা। যদিও বয়সের সাথে সাথে সবার মতই তাদের রঙেও ধূসরতা আসে।

ইউক্রেনীয় নারী আলেকজান্ড্রার সাথে পরিচয় হয়েছে কিছুদিন আগে।খুবই কাকতালীয়ভাবে। এক সকালে আমি তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সে তখন বোর্ডওয়াকে জড় হওয়া গাংচিলদের শুকনো পাউরুটি খেতে দিচ্ছিল। প্রায়শই চলতি পথে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, বর্ষিয়ান এই নারী গাংচিলদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন। খাবারের লোভে অসংখ্য গাংচিল তাকে ঘিরে ধরে। আমি নিজেও কয়েকবার এই দৃশ্যের ভিডিও ধারন করেছি। ইনস্ট্রাগ্রামের জন্য রিল বানিয়েছি।

হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম একটা ঝটিকা ঘূর্ণীবাতাস এসে আলেকজান্ড্রার মাথার সানক্যাপটি ঘুড়ির মত উড়িয়ে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। তার পক্ষে দ্রুত হাঁটা বা দৌঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সে অসহায় মুখ করে ক্যাপটির দুরন্তপনা দেখতে লাগলো। আমি একদৌড়ে ঘাড়ত্যাড়া ক্যাপটিকে কানে ধরে তার সামনে হাজির করলাম। সে একগাল হেসে ক্যাপটি নিয়ে মাথায় পরলেন। এবার ক্যাপের দু’ধারের লেইস দুটো দিয়ে গলার নীচে বেঁধে রাখতে ভুললেন না।

এতক্ষণে তার মনে পড়ল, আমাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। আমিও ধন্যবাদ পাওয়ার আশায় স্থান ত্যাগ করিনি।

আলেকজান্ড্রা তার টলটলে নীলাভ চোখ তুলে হাসলেন। বললেন, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মেয়ে। হাঁটুর জয়েন্টের ব্যাথাটা বড় জ্বালাচ্ছে, বুঝলে। তাই এখন আর চটজলদি উঠে দাঁড়াতে বা দ্রুত হাঁটতে পারি না। তবে সাগরে নেমে এখনও খুব সাঁতার কাটতে পারি। কিন্তু শীত এলেই বিড়াম্বনা। শীতে সাগরে নামা হয় না,  সাঁতারও হয় না।”

‘আমার মা’ও তোমার বয়সি। সেও সাঁতার জানে। কিন্তু তোমার মত সাগরে সাঁতার কাটার সাহস তার নেই।আর আমিতো সাঁতারই জানি না। আমার জীবন ষোলআনাই মিছে।তুমি কিন্তু এখনও সতেজ তরুনী!’

রূপের প্রশংসায় আলেকজান্ড্রা তার তোবড়ানো গালে টোল ফেলে হাসতে শুরু করলো। চেহারার মানচিত্র, শরীরের অবয়ব বলে দেয়, আলেকজান্ড্রা এককালে ডানাকাটা পরী ছিল। বয়সের বলীরেখা, ধূসর হয়ে আসা চামরার রং, রূপালি ঝিলিক দেয়া চুল যেন তার সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা এনেছে।

গল্পের আগ্রহ আমার তরফ থেকেই বেশী। ইচ্ছে ভিনদেশী মানুষদের সম্পর্কে জানা। বাস্তবে তারা আসলেই কেমন। কারন কনী আইল্যান্ডে বসতি গড়ার পর থেকেই ভাবছি, এদের সম্পর্কে জানবো। নিজের চেনা-জানা, বাস্তব মানুষদের নিয়ে গল্প লিখবো। তবে একধরনের শীতলতা, অনাগ্রহ লক্ষ্য করেছি এদের ব্যাবহারে। হয়তো সেটা আমার রঙের কারনে। কিংবা অন্য কিছু।

আলেকজান্ড্রার সাথে পরিচয়ের পর জানলাম সে ইউক্রেনীয়।ইংরেজি দিয়ে আলাপ শুরু করায় ভাষাগত দূরত্বও দূর হয়ে গেল। এখন ব্রাইটনের দিকে এলেই আমি তাকে খুঁজতে থাকি। প্রায়শই সকালে কিংবা বিকেলে তার দেখা মেলে। পাশে গিয়ে বসতেই সে কুশল জিজ্ঞেস করে। মাঝেমধ্যে জানতে চান, ‘একা কেন? তোমার স্বামী কোথায়? সবসময় দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটবে।গলা জড়িয়ে থাকবে। এই জীবনতো বেশী দিনের নয়। ফুরিয়ে গেলে আর পাবে না।’

আমি হাসতে হাসতেই বলি, ‘আমরা একসাথে হাঁটতে বের হলেও আমার স্বামী আমার থেকে দশ হাত সামনে থাকে। আমাদের বাঙালি কালচার তোমাদের মত নয়। অন্যরকম। স্বামী-স্ত্রী হলেও তারা পথেঘাটে হাত ধরাধরিতে দ্বিধা করে।গলাগলিতো খুব দূরের কথা। আমাদের দেশের পুরুষরা ভালোবাসা প্রকাশ করাকে দুর্বলতা মনে করে।বউকে ভালোবাসে এটা পরিবারে জানাজানি হলে তাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়।যেসব স্বামীরা প্রকাশ্যে বউকে ভালোবাসা দেখায় পরিবারের সবাই তাদের হেম্পেক্ট বা স্ত্রৈন্য ভাবে।’  

‘ওমা! সেকি কথা?’

‘হুম! তাই। তবে এটা আমার এবং আমার পূর্ববর্তী জেনারেশনের বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য ছিল। এখন জমানা বদলাচ্ছে। নতুন জেনারেশন এখন অনেক আধুনিক। তারা এখন পশ্চিমা রীতিনীতির ফলোয়ার। পুরানো ধ্যানধারনায় দ্রুতই বদল আসছে।’

‘তাও ভাল।তা তুমি কেমন আছ? তোমার মা এখানে আসে না? এলে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও কিন্তু’।

‘আমার মা যে ইংরেজি জানে না। তোমার সাথে কী করে কথা বলবে?’

‘তাতে কী? সে হাসতে জানেতো? আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেই অনেক কথা বলা হয়ে যাবে। আমি বুঝে নেবো। হাসির ভাষা সবাই বুঝতে পারে।’

আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি, আসলেই হাসি-কান্না এমন একটি আন্তর্জাতিক ভাষা যার অর্থ সবাই বুঝতে পারে। তাইতো আমরা ভিনদেশী, ভীনভাষার মানুষদের হাসি দেখলে আনন্দিত হই। কান্না দেখলে আমাদের চোখেও পানি আসে।

মাঝেমধ্যে আমি আলেকজান্ড্রার দেশের কথা জানতে চাই। শুনতে চাই তার ফেলে আসা দেশ ইউক্রেনের গল্প। সে সাগরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে কিছুক্ষনের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সম্ভবত ফিরে যায় তার অতীতে। সেখান থেকে একটু একটু করে, হাতরে হাতরে তুলে আনে খন্ডবিখন্ড কিছু কিছু স্মৃতি। যা তার বয়সের কারণে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।

আলেকজান্ড্রা হাসতে হাসতে জানালো, ‘আমরা ইউক্রেনের মেয়েরা রান্না করতে, পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘরোয়া খাবার খেতে ভালোবাসি। ফ্যাশনেবল কাপড়চোপড় পরতে, আড্ডা দিতে এবং নাচতে পছন্দ করি। হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসি। জীবনকে পজিটিভভাবে দেখি।’

‘আলেকজান্ড্রা তুমি এখনও অনেক সুন্দর। তরুণী বয়সে কী রূপসীই না ছিলে!’

আমার উচ্ছসিত প্রশংসায় আলেকজান্ড্রার গাল আরও রক্তিম হল। হাসিতে উদ্ভাসিত হল তার মুখ।

‘শুধু সোনালি চুল, নীলাভ চোখ নয়, আমরা মানুষ হিসেবেও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। আমরা আবেগে ভেসে যাওয়া মানুষ।’

আমি আমার ডানহাতটি নিজের ঠোঁটে ছুয়ে আলেকজান্ড্রার উদ্দেশ্যে চুমুর ভঙ্গি করলাম। লক্ষ করলাম, তার হাসিমুখে একটি বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এলো। যেন এক খন্ড মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিল।

‘জানতো, আমাদের দেশে একটি যুদ্ধ চলছে। বর্বর রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আত্মীয়, বন্ধুরা ভীষণ কষ্টে আছে। কত মৃত্যু হল। কত কিছু ধ্বংস হয়ে গেল। ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য আমাদের মন কাঁদে। বিশ্বাস কর, আমরা ভাল নেই। আমি যুদ্ধকে বড় ঘৃণা করি। আই হেইট ওয়ার!’

আমি আলেকজান্ড্রার একটি হাত ধরে বললাম, ‘বিশ্বাস কর, আমিও যুদ্ধকে ঘৃণা করি। খুব ঘৃণা করি।’

আমার মত আলেকজান্ড্রাও লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আটলান্টিকের পাড়ে এসে বসতি গড়েছে। শুধু পার্থক্য হল, সে এসেছে সুদূর ইউক্রেন থেকে। আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে। আমাদের গায়ের রং, ভাষা আলাদা হলেও অনুভূতিতে কোন ফারাক নেই। আমরা দুজনেই ঘরছাড়া, শেকড় ছেড়া মানুষ। শেকড় ছেড়ার যন্ত্রনা, কষ্টের একটাই রং।

চোখেমুখে উচ্ছাস এনে, হাসতে হাসতে বললাম, ‘আলেকজান্ড্রা, শীত বিদায় নিয়েছে। এসো আমরা সব কষ্ট ভুলে আনন্দ করি। স্প্রিং ইজ হিয়ার!’

“বাতাসে বহিছে প্রেম,

নয়নে লাগিলো নেশা

কারা যে ডাকিলো পিছে,

বসন্ত এসে গেছে।”

এখানে আমার বাংলা গানের তাল, লয়, সুরে ভুল ধরার কেউ নেই। তাই নির্ভয়ে, মনের আনন্দে, উন্মুক্ত সৈকতে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলাম! আলেকজান্ড্রা তার তুলতুলে নরম গালে টোল ফেলে হাসতে শুরু করলো। কী স্বর্গীয় সেই হাসি!

সম্পাদক ও প্রকাশক: মোতাহার হোসেন

মোবাইল: ০১৩৩২-৮৪৫৬৯৯

তথ্য ও প্রযুক্তি সহযোগী - আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.