৭ম বর্ষে পদার্পণ-সংবাদপত্রে পাঠকের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ, ২০২৩ ১১:৪৮ (মঙ্গলবার)
৭ম বর্ষে পদার্পণ-সংবাদপত্রে পাঠকের প্রত্যাশা

palonyউত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত– ‘প্রথম আলো’ বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় পত্রিকা, আজ তার জন্মদিন। আজকের এ শুভদিনে এ পত্রিকার সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা, নির্বাহী সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, কলাকুশলী ও পাঠকদের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে প্রিয় এ পত্রিকার অগ্রাযাত্রা কামনা করছি। প্রত্যাশা করছি পত্রিকাটি যেন দৃঢ়প্রত্যয়ে সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে চলে সামনের পানে।

‘প্রথম আলোর’ আমি একজন লেখক, দীর্ঘদিন থেকে এ পত্রিকায় আমার লেখা গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়ে থাকে। কিন্তু আমি আজ পাঠক। পাঠক হয়েই প্রশ্ন করছি সংবাদপত্রে কী পড়তে চাই? কী জানতে চাই? এর চেয়ে সহজ প্রশ্ন আর কি হতে পারে। তবু অনেক সময় সহজ প্রশ্নের উত্তর লেখাই দুরূহ হয়ে পড়ে। চট করে যদি জবাব দিতে হয় তাহলে বলবো সংবাদপত্রে দেশ-দুনিয়ার খবর পড়তে চাই। কোথায় কী ঘটছে তা জানতে চাই। কিন্তু সবসময় জানতে পারি কি?

জানতে পারি ততটুকুই যতটুকু সাংবাদিকরা দয়া করে আমাদের জানান দেন। তাতে সব সময় আমাদের কৌতুহল নিবৃত্ত হয় না। আমরা অনেক কিছু জানতে চাই। কিন্তু জানতে পারি সামান্যই। এক্ষেত্রে অনুমান করতে পারি সাংবাদিকদের সীমাবদ্ধতা আছে, কিংবা আমরা যা জানতে চাই পত্রিকার মালিক তা আমাদের জানতে দিতে চান না। সেখানে কর্মরত সাংবাদিক শত চেষ্টা করলেও তা আমাদের জানাতে পারবেন না। এটাও একটা বাঁধা। পাঠকের চাওয়া পাওয়া আর পত্রিকার নীতিমালার মধ্যে যদি ফারাক থাকে তাহলে পাঠক অনেকক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়। কাজেই পাঠকের এই পরিস্থিতি মেনে নিতেই হয়।

খুব সুক্ষ্মভাবে দেখলে আজকাল নিরপেক্ষ সংবাদপত্র বলতে কিছু পাওয়া যাবে না। প্রায় প্রত্যেক পত্রিকাই একটা বিশেষ দল, মত বা গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এটা যখন পত্রিকার অঘোষিত নীতি, তখন পাঠক যা চায় তা কি পত্রিকার পাতায় তেমন করে পায়? পাঠকরাও অবশ্য আজকাল সচেতন হয়ে উঠছেন। যাঁরা নানা দল, মত ও পথের সমর্থক, তাঁরাও বেছে বেছে তাঁদের মনপছন্দ পত্রিকাটি কিনে থাকেন। যাতে বেশি হতাশ হতে না হয়।

রাজনৈতিক ঘটনা পত্রিকাগুলো তার সুবিধামত রিপোর্ট করে থাকে। একটা স্বতঃসিদ্ধ বা জনসমক্ষে ঘটিত ঘটনাও দলীয় কাগজ তার দলের স্বার্থ রক্ষা করে রিপোর্ট করে। এসব ক্ষেত্রে লাজলজ্জারও বালাই নেই। পাঠকও তা মেনে নিয়েছেন। আজকাল দেশের অনেক কিছুই যখন দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয় তখন সাংবাদপত্রের কাছেই বা আমরা সুবিচার ও নিরপেক্ষতা আশা করবো কেন? সাংবাদপত্রের মালিক বা সম্পাদকও তো এই সমাজের মানুষ। তাঁকেও সমাজের অন্য দশটা কাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তবে ‘প্রথম আলো’ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে। এ পত্রিকাটি সংবাদ প্রচারে নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য প্রশংসিত।

অবশ্য প্রবীণ পাঠক বলতে পারেন, ‘সংবাদপত্র তো আলাদা একটি সম্মানিত প্রতিষ্ঠান। তাকে রাষ্ট্রের “চতুর্থ স্তম্ভ” বলা হয়। সাংবাদিক বা সম্পাদককে সমাজে বিশেষ সম্মানের

সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করি।’ খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু যদি সবিনয়ে বলি বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সম্পর্কে সাধারণভাবে আজ কী আর এত বিশেষণ ব্যবহার করা যায়? সংবাদপত্রের চেহারা দেখে বোঝা যায় আজ সার্বিকভাবে সাংবাদিকতার অবস্থান কোথায়।

খুব সংকোচের সঙ্গে বলতে পারি, সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সমাজ আজ সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই নিজেরা কোন স্রোত সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন না। কারণ এখন বাজার অর্থনীতি আর প্রতিযোগিতার যুগ। কাজেই ভিন্ন স্রোত সৃষ্টি করতে গেলে যদি পিছিয়ে পড়তে হয়, তাই এই ঝুঁকি কেউ নিতে রাজী নয়। কেউ রাজী নয় একথা বলাও বোধ হয় ঠিক হবে না। গেল ক’বছরে নতুন যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে, লক্ষ্য করেছি, তাঁদের মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব রয়েছে। গতানুগতিকতার বাইরে যাবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন, কী জানতে চাই? জানতে চাই তো অনেক কিছু। কিন্তু জানতে পাচ্ছি কোথায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম রিপোর্টাররা এক ধরণের গোয়েন্দা। কিন্তু সেই ‘গোয়েন্দাগিরির’ পরিচয় পাচ্ছি কোথায়? আজকাল খবরের কাগজে তদন্তমূলক রিপোর্টের খুব অভাব লক্ষ্য করি। অথচ পাঠক হিসেবে জানতে চাই কেমন করে এটা ঘটল? কারা এসব কাণ্ড করল? কিন্তু কোথায় সে রকম রিপোর্ট? খবরের কাগজ পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় মুখপাত্র বা প্রত্যক্ষদর্শী যতটুকু বিবরণ দেন সাংবাদিক সাহেবরা ততটুকু বিবরণ পাঠকের কাছে পৌঁছান। অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্টার আর একটু এগিয়ে গিয়ে খবর সংগ্রহ করতে চান না বা খবরের পেছনের খবর তুলে আনতে চান না। মনে হয় তিনি ‘কেঁচো’ খুঁড়তে চান না, এই আশংকায় , যদি ‘সাপ’ বেরোয়! অথচ আমাদের ধারণা, ‘সাপ’ বের করাই রিপোর্টারের কাজ। সমাজের অলিতেগলিতে যে সব ‘সাপ’ লুকিয়ে আছে সেগুলো বের করে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারলে পাঠক হিসেবে আমরা তৃপ্তি পেতাম।

সংবাদপত্রে চোর ডাকাতের খবর থাকে। এমনকি ছবিও। তার তুলনায় কৃতি লোক, গুণীলোকের খবর থাকে কম। এমনকি অনেক গুণীলোকের ছবি ছাপা হয় মৃত্যুর পরে। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের যত খবর ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হয় তার সবটুকু গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুনও নয়। ‘খবর’ হবার উপযুক্ত নয় অথচ কী এক মোহের বশে বা পাঠকের চাহিদা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনাবশত পত্রিকাগুলো রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বিস্তর লেখা ছাপায় যা প্রায় সময় ক্লান্তিকর ও পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। এ ব্যাপারে খুব দ্বিমত হবে না যে, আমাদের দেশের রাজনীতির মান খুব উঁচু নয়। চিন্তাশীল, শিক্ষিত ও কর্মোদ্যোগী ব্যক্তির সংখ্যাও রাজনৈতিক অঙ্গনে কম। আমরা নানা কারণে অনেককে নেতার আসনে বসাই বটে, কিন্তু সত্যিকার নেতা হওয়ার গুণাবলী অনেকের নেই। সংবাদপত্রগুলো এসব কৃত্রিম নেতাকে এমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরে যে তাতে সমাজ বিভ্রান্ত হয়। এমনকি ‘নেতাও’ বিভ্রান্ত হয়ে নিজেকে কেউকেটা হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। সংবাদপত্রের রয়েছে একটা অদ্ভুত শক্তি। তার প্রকাশগুণে সাধারণও ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠে। পাঠক হিসেবে এটা আমি আশা করি না। আমার প্রত্যাশা, সংবাদপত্র ব্যক্তিকে তার গুণপনা, অবদান, ভূমিকা ইত্যাদি দিয়ে বিচার করবে বা বিচার করবে ঘটনার পটভূমিতে কিংবা বক্তব্যের ওজন দিয়ে। এর বাইরে যারা তারা সাধারণ। কোন কোন সময় পদের কারণে কাউকে কাউকে গুরুত্ব দিতে হয় বটে। কিন্তু তারও একটা আকৃতি থাকা উচিত। সংবাদপত্র যদি ভালো মানুষ, ভালো কাজ, অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত ব্যাপকভাবে তুলে ধরে তাহলে সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আমাদের সংবাদপত্র এখনও নেতিবাচক ঘটনার প্রতিই বেশী আগ্রহী। গুণ্ডা, বদমাশ, খুনি, হাইজ্যাকারের ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় যত ছাপা হয়। ভালো বা গুণীলোকের ছবি তত ছাপা হয় না। এরশাদের ছবি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় যতবার ছাপা হয়েছে অধ্যাপক আবুল ফজল বা দেওয়ান আজরফের ছবিও এতো ছাপা হয়নি। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজের যেখানে সামান্য ভাল কাজ

হচ্ছে , উৎপাদন হচ্ছে, রপ্তানি হচ্ছে, নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে, নতুন কিছু আবিস্কার হচ্ছে তাকে তুলে ধরতে হবে নিষ্ঠার সাথে। আর একই সঙ্গে খারাপ জিনিসও তুলে ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে। বলতে হবে এটা অন্যায়। এটা নিন্দাযোগ্য। সংবাদপত্রের সম্পাদক প্রকাশক যদি পাঠকের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে চান তাহলে পত্রিকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে নতুন করে ভাবা দরকার। দশ বা পঞ্চাশ পৃষ্ঠার পত্রিকায় বহু কিছু বাদ দেয়ার মতো থাকে, আবার নতুন কিছু সংযোজনেরও অবকাশ রয়েছে। প্রতিটি পত্রিকা চাইলে পাঠক চাহিদা জরিপ করতে পারেন। প্রতি দু’বছর অন্তর পাঠক চাহিদা জরিপ করে পত্রিকার পরিকল্পনা ও বিষয়বস্তু পুনর্বিন্যাস করা যায়। আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, পত্রিকা তো আসলে পাঠকের জন্যেই। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: মোতাহার হোসেন

মোবাইল: ০১৩৩২-৮৪৫৬৯৯

তথ্য ও প্রযুক্তি সহযোগী - আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.