প্রথম আলো, নিউইয়র্ক: বৃত্তভেদী সংবাদপত্র
বাংলাদেশের বাইরে বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে ছোট-বড়, প্রাণবন্ত বাংলাদেশ। এসব দেশে বাঙালি জনসমাজ ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নুতন নুতন কেন্দ্র। 'মাহীনের ঘোড়া গুলো'-ব্যান্ডের গানের কথার মতো-'পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/স্যাটেলাইট আর কেব্লের হাতে/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী।
পরের স্তবকের শেষ দুটো চরণ’তো অসাধারণ, 'যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে/ঘুচে গেছে দেশ কাল সীমানার গণ্ডী'
সত্যি ঘুচে গেছে দেশ, কাল, সীমানার যত গণ্ডি। পরিবারের সদস্যরা ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো কেউ লন্ডন, কেউ নিউইয়র্ক, কেউ ক্যালিফোর্নিয়া। কোন কোন পরিবারের সদস্যরা আছেন ইউরোপের দেশে দেশে। প্যারিস, বন, রোম এখন বাংলাদেশের হৃদয়ের বর্ধিত অংশ। পরিবারগুলো যখন ছড়িয়ে যাচ্ছে ভূগোলকের এধার ওধার, পরিবারের সাথে যাচ্ছে উৎসব, আনন্দ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। বাঙালি প্রবাসী হলে সংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হয় বেশি। সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায়, সন্তানরা যদি শেকড় ছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর থাকলো বা কী? তাই প্রয়োজন নববর্ষ পালন, বসন্ত উৎসব, শরৎ বন্দনা, নবান্ন উৎসব।
বাঙালির এই বাঙালিয়ানাকে পরিপুষ্ট করে তুলতে, জনসমাজের কাছে তথ্য, বিনোদনের মাধ্যমে সৌহার্দ্য তৈরিতে প্রয়োজন সংবাদপত্রের। গত সাত বছর ধরে একটি সংবাদপত্র ধীরে ধীরে সেই কাজটি করে যাচ্ছে। দিন দিন এই সংবাদপত্রটি জনসমাজের সহায়তায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠান কথাটি বড় মাপের তারপরও নিজের পর্যবেক্ষণের প্রতি আস্থা রেখে উচ্চলয়ে কথাটি বলে ফেললাম। একটি সংবাদপত্র যে খুব কম সময়ে প্রতিষ্ঠানের মতো সেবা দান করতে পারে, তা’ প্রথম আলো-নিউইয়র্কের ভূমিকা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে উপলব্ধি করা কঠিন। প্রথম আলো-নিউইয়র্কের বয়স যখন এক বছর ছয়মাস, তখন থেকেই নিবিড়ভাবে সঙ্গী হয়েছি। সাড়ে পাঁচ বছর ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলে অনেক কথাই বলা যায়। মনের গহীনে সঞ্চিত সব কথা পাঠকের সাথে ভাগ করার স্পেস সম্পাদক আমাকে দিতে পারবেন না, তাই চুম্বক কথার কিছু অংশ ভাগ করে নিচ্ছি।
প্রথম আলো, নিউইয়র্কের অধিকাংশ লেখক, সাংবাদিক, প্রদায়ক, বিভাগীয় সম্পাদক অবস্থান করেন নিউইয়র্কে। আমি বাস করি ঢাকা শহরে। নিয়মিত লেখক হিসাবে সম্পাদক এবং তার তারুণ্যমণ্ডিত দল কখনো মনে করেন না আমি দূরে আছি। প্রথম আলোর যত ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠান হয়েছে আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। অধিকাংশ সংবাদকর্মী
এবং লেখকদেরকে সাথে আমার সরাসরি পরিচয় নেই কিন্তু তারা আমাকে এতই আপন করে নিয়েছেন যেন পাশাপাশি টেবেলে বসে কাজ করা সহকর্মী। এই ভার্চ্যুয়াল যুগে মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে এ’ভাবেই বোধহয় আত্মার অংশ হওয়া সম্ভব হয়।
“যৌবন-তারুণ্য” বিষয়টি সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। কথাটি বলেছিলেন চিরযৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারুণ্য বিষয়টি মনের। যৌবনের তারুণ্যের ছায়া যদি সৃষ্টিশীল কর্মে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে সৃষ্টিশীলতা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। প্রথম আলো নিউইয়র্কে তারুণ্যের প্রতিফলন আছে। সংবাদ পরিবেশনায়, অভিমত উপস্থাপনায়, সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগে এই তারুণ্য আমি দেখতে পাই। উত্তরের নকশা, বিভাগটির উপস্থাপনা যে কোন পাঠক কে মুগ্ধ করবে। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন নকশার প্রতিটি সংখ্যা। বিষয়বস্তু, ছবি, অলংকরণ যেমন উচ্চমানের ছাপাও তেমন ঝকঝকে। যারা শুধু লেখালেখিতে তারুণ্য আছে শুনে অপরিপক্কতার কথা চিন্তা করবেন কিংবা নাক কুচবাবেন তাদের জন্য বলছি, প্রথম আলো, নিউয়র্কের প্রতিটি সংখ্যায় তারুণ্যের সাথে আছে গভীর বোধের সম্মিলন। এই সমন্বয়, সম্মিলনে পত্রিকাটি সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে হয়ে উঠছে গ্রহণীয়। প্রথম আলো নিউইয়র্কের টার্গেট পাঠক কারা? অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায়। প্রযুক্তির কারণে এখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বাঙালি এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রটি পাঠ করে থাকেন। বিষয়টি টের পাই, আমার বিশ্বাস আমার মতো অন্যান্য লেখক, সাংবাদিক এবং স্বয়ং সম্পাদকও বিষয়টি অনুভব করেন। আমি গড়ে প্রতি মাসে দুটো লেখা প্রথম আলো নিউইয়র্কে লিখে থাকি। লেখা প্রকাশের পর পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের অনেক কোন থেকে বাঙালি পাঠকেরা আমার সাথে যোগাযোগ করেন, তাদের ভালো লাগার কথা জানান। আশ্চর্য হয়ে যাই প্রথম আলোর মান এবং উচ্চ প্রযুক্তির কারণে পত্রিকাটিকে যখন দেখি দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃসন্দেহে সম্পাদক এবং তার দলকে কুর্নিশ জানাতে হয়।
এবার ফিরে আসি প্রতিষ্ঠানের কথায়। প্রথম আলো নিউইয়র্ক, সংবাদপত্র হিসাবে শুধু প্রবাসী বা স্বদেশী বাঙালিদের সংবাদ পরিবেশন এবং অন্যান্য বিভাগের মাধ্যমে পাঠকের সংবাদ ও বিনোদনের ক্ষুধা মিটিয়ে শুধু প্রথাগত দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে না। বৃত্তের বাইরে আমরা দেখি নিয়মিত পদচারণা সংবাদপত্রটির। এই পদচারণার ফলে কী হচ্ছে-নানা রকম সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে প্রথম আলো নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের বাঙালি জনসমাজ প্রথম আলোকে ঘিরে নানাভাবে একত্রিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় অভিনেতা, গায়ক, গায়িকা, চিত্রপরিচালক, কবি, সাহিত্যিক, চিন্তক সকলেই যখন নানা কাজে নিউইয়র্ক যান তখন তাদেরকে ঘিরে দেখি প্রথম আলো কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে নানা আয়োজন। এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন না করলেও চলে; প্রথম আলো নিউইয়র্ক জনসমাজকে প্রবাসে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনোদনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রাখতে চায়, এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সম্প্রতি আমরা দেখছি প্রথম আলো ফেসবুক পেজ থেকে নানা প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। এতে করে পাঠক এবং বাঙালি জনসমাজ অভিবাসন এবং নানা প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে, পরামর্শ পেয়ে যাচ্ছেন। মুদ্রিত সংবাদপত্র, অনলাইন সংস্করণ, ফেসবুক পেজ, বইমেলায় অংশগ্রহণ, সাপ্তাহিক, মাসিক সাহিত্য আলোচনা সব মিলিয়ে প্রথম আলো নিউইয়র্ক, সংবাদপত্রেরও অধিক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে দিন দিন।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব বাংলাদেশে বাঙালিরা সকল অবস্থায় ইত্তেফাক ও বিবিসির প্রতি আস্থা রাখতেন। ইত্তেফাকে মুদ্রিত কোন সংবাদ কখনো মিথ্যা হতে পারে না। একইভাবে বিবিসি কখনো অসত্য সংবাদ পরিবেশন করতে পারে না, এরকম আস্থা ছিলো সংবাদ মাধ্যম দুটির প্রতি। এই আস্থা, এই ভরসা অর্জন করা খুব সহজ কোন কাজ নয়। প্রথম আলো নিইয়র্ক, এই কঠিন কাজকে দিনে দিনে সহজ করে তুলছে। পাঠক ও সংবাদপত্রের নানাভাবে কাছাকাছি আসা, বিশ্বাস, আস্থা অর্জন করার মাধ্যমেই প্রবাসে একদিন প্রথম আলো নিউইয়র্ক এক নুতন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। সে’দিনের প্রতীক্ষায় আকুল হয়ে থাকলাম।
আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.