এসো নীপবনে
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’, বিখ্যাত এই গানের সঙ্গে কয়েক‘শ প্রবাসীর উপস্থিতিতে ২০১৬ ‘প্রথম আলো’র উত্তর আমেরিকার যাত্রা শুরু হয়েছিলো। সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের কুইন্সের ওয়ার্ল্ডসফেয়ার মেরিনায় ‘প্রথম আলো’ সম্পাদক মতিউর রহমান এক ভিডিও বার্তায় উত্তর আমেরিকা প্রবাসীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম আলো সামনে এগোচ্ছে পাঠকের ভালোবাসায়। এরই অংশ হিসেবে উত্তর আমেরিকায় আগামী মার্চে সাপ্তাহিক হিসেবে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে প্রথম আলো।’ ‘প্রথম আলো’র উত্তর আমেরিকার এ যাত্রায় তিনি সবাইকে সঙ্গে থাকার আহ্বান জানান। দূরপ্রবাসে বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলো বাংলা ভাষীদের হাতে তুলে দেওয়ার আনন্দযজ্ঞে সেদিন উপস্থিত ছিলাম। রুপু ভাই, সেলিনা, সাগর ভাই, নিম্মি, ইব্রাহীম চৌধুরী ভাইজানসহ সবার ছুটাছুটি দেখছিলাম। অনুষ্ঠানে আসা প্রবাসে জন্ম নেয়া ক্ষুদে শিল্পীদের অসাধারণ পরিবেশনা মুগ্ধ চোখে দেখেছি। আর ভাবছিলাম শখ যেহেতু লেখালেখি তাই প্রবাসে এসে সহজে ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে যুক্ত থাকা যাবে। সেদিন থেকেই আমার যাত্রা শুরু বলা যায়।
আমার এখনো মনে আছে মঞ্চে হাসান ফেরদৌস ভাই-ই প্রথম বলেছিলেন, ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো।’ আজকে দিনে এসে তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। সত্যিই তাই ‘প্রথম আলো’ ভালোর সঙ্গে আছে বলেই প্রবাসের মানুষের কাছেও এত জনপ্রিয়। ‘প্রথম আলো’র উত্তর আমেরিকা যাত্রাকালে পেশাদার অভিজ্ঞ সংবাদকর্মীদের
নিয়ে নতুন অভিযাত্রার কথা জানান তিনি। ‘প্রথম আলো’ উত্তর আমেরিকার সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘প্রথম আলো কথা বলবে প্রবাসের বাংলা ভাষীদের, কথা বলবে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের।’ সেই থেকে আজ অবধি একজন দক্ষ নাবিকের মতো মাস্তল হাতে তিনি একদল কাজ পাগল মানুষ নিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন অসীমের উদ্দেশ্যে। আমি আমার বর একেবারেই পেছনের সারিতে থেকে সেদিনের অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলাম। নিম্মি নাহারের উপস্থাপনায় সবশেষে মঞ্চে আসেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। ‘তীর হারা’ দিয়ে শুরু করে তিনি একে একে ছয়টি গান শোনান। এরপরই মঞ্চে আসেন মুক্তিযোদ্ধা কামাল সাঈদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। এসময় হলজুড়ে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এই সময়ে এসে মনে আসে যে, ‘প্রথম আলো’ নিউইয়র্কে আসছে জেনে অনেকেই ভীষণ সমালোচনা করেছেন। এই পত্রিকার গুণগ্রাহী বন্ধুরা রীতিমতো চায়ের আসর করে এর বিরোধিতা করেছেন। তখন মনে হয়েছিলো, অন্য পত্রিকার সাথে বিজ্ঞাপন ভাগাভাগি হওয়ার বাইরে আর কি এই সমালোচনা কারণ হতে পারে! তবে এই শহরের মানুষের মাঝে ‘প্রথম আলো’কে ঘিরে আগ্রহ কৌতুহল ছিল অপরিসীম, যা এখনো বহাল আছে। নিউইয়র্ক থেকে দেশে তথা বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী পাঠক সমাদৃত পত্রিকা ‘প্রথম আলো’ সপ্তম বছরে পদার্পণ করলো। পত্রিকাটি আলোচনা সমালোচনার বাঁধা পেরিয়ে এই শহরে বাংলা সংবাদপত্র জগতে আধুনিকতার সূচনা করেছে। ক্ষুরধার লেখনী আর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকপ্রিয়তা যেমন পেয়েছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে অনেক মেধাবী লেখক ও সংবাদকর্মী। গণমানুষের কথা বলার অধিকার ও ন্যায্য দাবি পূরণে এবং বাংলাদেশকে সার্বিকভাবে এগিয়ে নিতে ‘প্রথম আলো’ উত্তর আমেরিকা বরাবরই অসীম সাহসিকতা আর নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে। এর ডিজিটাল ভার্সন এসে বিদেশের মাটিতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বলছে , যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
যেখানেই মানুষ অধিকার বঞ্চিত হয়, সেখানেই সাহসী ভূমিকা রাখে ‘প্রথম আলো’। তাই দিনে দিনে গণমানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছে পত্রিকাটি। শুধু নিউইয়র্কে নয় দেশের অনেকেই এতে নিয়মিত লিখছেন এবং পড়ছেন। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি, অধিকার, ব্যথা-বেদনার কথা নিয়মিত বলে যাচ্ছে এ পত্রিকা। প্রযুক্তির কল্যাণে মুঠোফোনের মাধ্যমে শহর থেকে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছে এই পত্রিকা। তবুও সমালোচকদের বলতে শুনি, বাছবিচার ছাড়াই যাকে তাঁকে এখানে লেখক বানিয়ে দেয়া হয়। এতে সমস্যা কোথায় বুঝে আসে না। লেখকই তো বানায় চোর ডাকাত তো না। একমাত্র লেখকরাই বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য শিল্প এবং সৃজনশীল লেখার জন্মদান করেন। উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা, নাটক, চিত্রনাট্য এবং প্রবন্ধ পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবেদন, খবর, নিবন্ধ যা মূলত জনকল্যাণমুখী। ‘প্রথম আলো’তে নবীনদের যেভাবে সুযোগ দেওয়া হয় সেটাও বলার মতো। বাংলা ভাষাভাষী পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে তরুণ, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ লিখতে পারে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা. স্বপ্ন আর সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে।
মহামারির সময়ে এই শহরে অন্য সকল পত্রিকা যখন বন্ধ ছিল তখন একমাত্র ‘প্রথম আলো’ উত্তর আমেরিকা তার সাহসিকতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে। করোনাকালে গুরুত্বপূর্ণ খবর ও নিয়মিত আপডেট নিয়ে মানুষের দুয়ারে উপস্থিত থেকেছে যা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। এছাড়া অনেক জাতীয় বিষয়ে সাহসী রিপোর্ট করেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ পত্রিকায় সব পেশা, শ্রেণি, ধর্ম ও গোত্রের সব খবরাখবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সব বিভাগ পাঠকের মন জয় করতে পেরেছে। দেশের তথা প্রবাসী পাঠক যা চায় এবং যেভাবে চায়- তাদের মনের কথা, মনের ভাষা বুঝেই এর প্রতিটি বিভাগ সাজানো হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদের পাশাপাশি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদক, বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, ভূমিদখল, পাহাড় কাটাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী সব খবর এখানে গুরুত্বপায়। স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদ
সমান গুরুত্বের সঙ্গে এতে উঠে আসে। এই পত্রিকা পাঠকের মনের ভাষা বোঝে। তাই এ পত্রিকার পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও লেখকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পত্রিকাটি নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে রাখতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মসহ সব বিষয়ের সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। এর মধ্যে নতুন সংযোজন ভিডিও রিপোর্টিং। সাথে সাপ্তাহিক টক শোর এগিয়ে চলার আরেকটি মাইলফলক হিসেবে যুক্ত হয়েছে, যা ইতোমধ্যেই এই শহরের মানুষে মনে জায়গা করে নিয়েছে।
উত্তর আমেরিকা প্রথম আলোর নিয়মিত আয়োজনে থাকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সম্পাদকীয়, খেলাধুলা, নকশা, বিনোদন, সাহিত্য, অর্থনীতিসহ অনেক বিষয়। এসব বিষয়ে মানসম্পন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণমূলক লেখা দিয়ে মানুষকে উপকৃত করে পত্রিকাটি। সংবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও এই পত্রিকা সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে। দক্ষ ও ইউনিক সম্পাদনার মাধ্যমে এরই মাঝে জনকল্যাণে গড়ে তোলা হয়েছে প্রথম আলো ফাউন্ডেশন। ইতোমধ্যেই করোনা মহামারি থেকে ও বন্যাদুর্গত এলাকায় সাহায্য নিয়ে মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছে এর দক্ষ কর্মীরা। এসবের মাধ্যমেই উত্তর আমেরিকা ‘প্রথম আলো’ সক্রিয়ভাবে দেশ ও জনগণের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। বাংলাদেশের তথা নিউইয়র্কের মানুষের কাছে ভালোলাগা ও নির্ভরতার সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ প্রতিষ্ঠার সপ্তম বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। বর্তমান অনিশ্চয়তার সময়ে এসে একটি পত্রিকা শুধু সংবাদেই আটকে না থেকে নানারকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত রেখে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। সাপ্তাহিক প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সাথে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দুঃখ-দুর্দশা, সংকট আর সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে মানুষের ভালোবাসার মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। আমি এর একজন ক্ষুদ্রলেখক ও পাঠক হিসেবে সপ্তম বর্ষে পদার্পণে উত্তর আমেরিকা ‘প্রথম আলো’ পরিবার ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিবাদন জানাই। সেই সাথে পাঠকনন্দিত পত্রিকার শুভকামনা করি যেন সামনের পথচলা আরো সুগম ও সার্থক হয়। এর দক্ষ সম্পাদক, প্রতিবেদক,
বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা। উত্তর আমেরিকা ‘প্রথম আলো’ দীর্ঘজীবী হোক এবং আরও অনেক সফলতা অর্জন করুক। তাই পরিশেষে কবিগুরুর ভাষায় সবাইকে এর পাশে থাকতে আহ্বান জানাই ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে’।
আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.