আগুনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবাজার, পেছনে দৈব না দৈত্য?
এদেশের দৈব দুর্বিপাকে পড়া এবং অসহায় মানুষদের স্রেফ ভিখারি ভাবে একটা শ্রেণি। কেউ তাদের খাওয়ানোর কথা গর্ব ভরে প্রচার করেন। যাকে খাওয়ার খোটাও বলা যায়। কেউ দান-খয়রাতের উদ্যোগ নেন ধর্মীয় উৎসবে রাস্তা জুড়ে বসা মৌসুমি ভিখারি গণ্য করে। তাদের কারো ধারণায় দেশের এসব মানুষদের তারাই খাওয়ান-পরান, বাঁচিয়ে রাখেন। অথচ এসব মানুষেরাই দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এদের টাকা দেশেই থাকে, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে। বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে শ্বাসরুদ্ধ করার ইতিহাস এসব মানুষদের নেই। দানের নামে এসব মানুষদের ভিখারি প্রতীয়মান করার চেষ্টা সঙ্গতই দৃষ্টিকটু।
সাকিব আল হাসানের কথা বলছি। সে বিশ হাজার টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবাজারের দুর্বিপাকে পড়া ব্যবসায়ীদের জন্য। প্রথমে দৈব দুর্বিপাকের কথা বলেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবাজারের দুর্বিপাক দৈব কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেখানের ব্যবসায়ীরা খোদ। এছাড়াও রাজনৈতিক দোষারোপও দৈব বিষয়টাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। সত্যিকার অর্থেই এখন অনেক দুর্বিপাকই আসলে দৈব না মনুষ্য সৃষ্ট তা নিয়ে বড় একটা প্রশ্নবোধকের উৎপত্তি হয়েছে।
সাকিবের কথায় আসি। কদিন আগে আরাভের জুয়েলার্স উদ্বোধন বিষয়ে সাকিবের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো সাকিবকে এখানে অযথা টেনে আনা হয়েছে এবং তা মূল ফোকাসটাকে সরিয়ে নেয়ার জন্য। তাই কথা বলা। এবার বলছি সাকিবের বিশ হাজার টাকা দানের ঘোষণা বিষয়ে। সাকিব খুব ধনী পরিবার থেকে উঠে আসেনি যে তার কোনো অপ্রাপ্তির স্মৃতি নেই। তাহলে হয়তো মানুষের এমন অবস্থা বোঝার অনুভূতি থাকতো না। অতীত ভোলা শুধু বিস্মৃত রোগের রোগীদের পক্ষেই সম্ভব। সাকিব সুস্থ। সুতরাং তার বর্তমান অবস্থান থেকে বিশ হাজার টাকার টোকেন অনুদান ঘোষণা শুধু ধৃষ্ঠতা নয়, একধরণের রসিকতাও। যেখানে তাহসানের মতন একজন, যিনি রোজগারে সাকিবের সম্ভবত ধারেকাছেও নন। তবু তিনি পোড়া কাপড় কিনেছেন এক লাখ টাকায়। খেয়াল রাখবেন, কিনেছেন, দান করেননি। এটা হলো সেই টোকেন যা সম্মানের সাথে দেয়া। সাকিব এখানে ব্যর্থ। যার ফলে তার সমালোচনা হয়েছে এবং হওয়া স্বাভাবিক।
সাকিবের সমালোচনার বিরোধীতা অনেকে করেছেন। তাও স্বাভাবিক। সব মানুষের চিন্তা একরকম হতে পারে না, হয় না। সুতরাং মত-ভিন্নমত থাকবেই। তারপরেও সাকিব আল হাসানের এই টোকেন দানের ঘোষণা সেই মৌসুমি ভিখারিদের নতুন টাকা দেয়ার মতনই মৌসুমি চিন্তা।
সুতরাং এইসব মৌসুমি চিন্তা সাথে রাজনীতিবিদদের মৌসুমি দোষারোপ এসবই বাদ দিয়ে আসল বিষয় নিয়ে কথা বলাটাই মূলত উচিত। আসল কথা খুব বড় নয়। ব্যবসায়ীরা সে কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। তারা বলেছেন, তারা বঙ্গবাজারেই ব্যবসা করতে চান। তাদের পোড়া দোকানের জায়গায় নতুন করে আবার দোকান গড়ে তুলতে চান।
এখন মূল প্রশ্ন হলো এই চাওয়াটা কেন? তবে কি তাদের আশংকা তাদের ব্যবসার জায়গা বেহাত হয়ে যাবে? আর এই আশংকা এবং সম্ভাবনাকারণও রয়েছে। বঙ্গবাজারে বহুতল মার্কেট নির্মাণের কথা শুনে আসছি অনেকদিন থেকেই। এসব ব্যাপারে মামলার বিষয়ও রয়েছে। পুড়ে যাবার পরও কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, এখানে বহুতল মার্কেট হলে এমন ক্ষতি হতো না। উদ্ধৃত হচ্ছে, মার্কেট করে দেয়ার পূর্বেকার ইচ্ছের কথাও। এসব কথার বিপরীতে অনেকে আড়েঠারে বলছেন, বস্তি এবং এসব মার্কেটে আগুন এমনিতেই লাগে না। এখানে দৈব’র যোগ নেই, দৈত্যের যোগ রয়েছে। সামাজিকমাধ্যম এখন এমন আলোচনায় সয়লাব। কোনো গণমাধ্যমেও সামাজিকমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে এমন কথা উঠে এসেছে।
পাকা বহুতল মার্কেটের কথা উঠছে। প্রশ্ন ও মুশকিল দুটোই হলো যারা এসব কথা বলেন তাদের চিন্তার গভীরতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে। পাকা বহুতল মার্কেট হলেই এমন ক্ষয়ক্ষতি হতো না এমন গ্যারান্টি তারা কোথা থেকে পেলেন। রাজধানীতে ইতোপূর্বের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে বহুতল মার্কেট হলে ক্ষতি হতো না এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। সবচেয়ে বড় কথা আগুন নিয়ন্ত্রণের আধুনিক ব্যবস্থা আমাদের নেই। আগুনে হেলিকপ্টার দিয়ে পানি ছিটানোর দৃশ্য যারা দেখেছেন, তাদের সামাজিকমাধ্যমে করা মন্তব্যগুলো পড়ে দেখতে পারেন, কীভাবে সমালোচনা করেছেন তারা। হেলিকপ্টার আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহৃত হয় সত্যি, কিন্তু বর্তমান যুগে বাকেট দিয়ে পানি নিয়ে ঢেলে দেয়ার জন্য নয়। আগুনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফোম কিংবা অন্য রাসায়নিক ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য। বিভিন্ন দেশে তাই করা হয়।
অনেকে উন্নতির প্রশ্নে নানান আলাপ করেন, কিন্তু প্রকৃত উন্নত দেশে আগুন নেভাতে ফোম, ফায়ার বলসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়। সাথে ব্যবহৃত হয় রোবট। আমাদের উন্নতির গল্পে এসব পুরোপুরি অনুপস্থিত। বিপরীতে আগুনের ঘটনা ও গল্প কিন্তু চলমান। একটার পর একটা ঘটছেই। সাথে ঘটে চলছে উন্নতির মৌসুমি আলাপ এবং দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে ভিখারি ভাবার প্রবণতা। একটা ঘনবসতি পূর্ণ শহর, যেখানে ঘিঞ্জি এলাকার অভাব নেই, সেই শহরে আধুনিক অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক এবং বিকল্পহীন। আর সেটা না থাকলে উন্নতির আলাপ অর্থহীন।
তবে শেষ কথা হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এমন দুর্বিপাক যেন দৈব থেকেই হয়, পেছনে দৈত্য যেন না থাকে। তার সাথে বিশ্বাস করতে চাই,দুর্বিপাকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের যেন মৌসুমি ভিখারি হিসেবে চিন্তা না করে তাদের সত্যিকার পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কারো কারো কথা সামাজিকমাধ্যমে শুনেছি। তারা বলেছেন, ‘রাতে শুয়েছি বাদশা হিসেবে, সকালে উঠে দেখি ফকির’। এমন অবস্থা সবারই হতে পারে। রাতের বাদশা, সকালের ভিখারি। সকালে ক্ষমতায়, রাতে কারাগারে। দৈব’র ইচ্ছের কথা কিছু বলা যায় না। সুতরাং খাওয়ার খোটা দেয়া, মৌসুমি ভিখারি ভাবা এমন অহঙ্কারের আলাপ আর চিন্তা থেকে বিরত থাকাই ভালো। না হলে মানুষ সবকিছুকেই দৈব নয় দৈত্যের কাজ হিসেবেই ধরে নেবে।
আইটি ল্যাব সলিউশন্স লি.