https://voiceofpeople24.com/
3598
sylhet
প্রকাশিত : ২৩ মার্চ ২০২৩ ০৮:১১ | আপডেট : ৩০ নভেম্বর -০০০১ ০০:০০
১-
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাই
সুব্রত বিশ্বাস
বীর মুক্তিযোদ্ধা
----------
সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম সমাজ ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা দায়বদ্ধতা সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের পূর্বশর্ত। অথচ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এমনটি ভেবে আশান্বিত হবার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখি না। মূলত, বেশিরভাগ সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের বিপরীতমুখীন ভূমিকা ও অবস্থান। দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতাবোধ স্বার্থের উলঙ্গ বিকৃতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত। বস্তুত স্বার্থের প্রয়োজনে গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসা চরিতার্থই জরুরি। তাই যাঁদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তাঁরাসহ সমস্ত অংশের সাধারণ মানুষের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের স্বার্থপর ভূমিকা নিতান্তই অনভিপ্রেত।
অপরদিকে গণতন্ত্রে স্বাধীন ও সজীব গণমাধ্যমসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সাধারণ মানুষ তথা সমাজের প্রতি সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে বহু পুরানো টানাপোড়েন আজ আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। সাধারণভাবে ধারণা হচ্ছে, দেশের গণমাধ্যম মাঝেমধ্যেই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা পালন করে। এবং তারা নিতান্ত আত্মসমালোচনাবিমুখ ও অসংবেদনশীল। আবার নিজেরা নিজেদের খুবই নীতিনিষ্ঠ মনে করেন।
এরূপ অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা রীতিমতো ভেবে-চিন্তে উত্তেজনা সৃষ্টির ভূমিকা পালন করেন। তাদের কাছে কাগজের ছাপার অক্ষরকে স্পর্শকাতর করে তোলাই আসল কথা। তার জন্য তারা কোন ঘটনার সৎ বা বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনার সঙ্গে আপোস করতেও দ্বিধা করেন না। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে ঐ উপস্থাপনাই অনেক মূল্যবান। এতদ্ব্যতীত সাম্প্রতিক সময়ে অর্থের বিনিময়ে বিশেষ স্বার্থবাহী সংবাদ প্রকাশের বিষয়টিও এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে। যা আসলে সংবাদের সৎ বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনাকে প্রহসনে পরিণত করেছে।
মিডিয়ার একই ভূমিকা নিয়ে ইদানীং আমাদের দেশেও প্রশ্ন উঠেছে। একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে নৈতিকতা বিকিয়ে দিতে একেবারেই দ্বিধাহীন। এমন অনেক সাংবাদিকই আছেন, যারা রীতিমতো ভেবেচিন্তে উত্তেজনা সৃষ্টির ভূমিকা পালন করেন। বীভৎসতা দেখানোর অতিরঞ্জন নিয়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিযোগিতামূলক কাল্পনিক ও মনগড়া সংবাদ প্রকাশ নিয়ে একই প্রশ্ন উঠেছে।
বিভিন্ন সময় এসব ঘটনায় সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ উঠেছে, ভূমিকার সমালোচনাও হয়েছে অনেক। তা সত্বেও তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার ধরণে কোন পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে।
এছাড়া ‘অর্থ ও স্বার্থের বিনিময়ে সংবাদ’ প্রকাশের বীজ কত গভীরে প্রোথিত, কীভাবে এই দুর্নীতি সংবাদমাধ্যমকে গ্রাস করেছে, তা জানার জন্য সাংবাদিকদের ইচ্ছার প্রবণতা কতটুকু। তাছাড়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও এর ভূমিকার ওপর নজরদারি সংবাদমাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ করে বলে মনে হয় না, বরং বিতর্কে না গিয়ে এধরনের ঘটনার জন্য কাউকে চিহ্নিত করার দায় এড়িয়ে চলে। তা করতে পারলে হয়তো যারা এর সঙ্গে যুক্ত, তারা কিছুটা লজ্জা পেতেন। সংবাদমাধ্যমের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা জোরালো ভিত্তি পেত। কিন্তু বাস্তবে ঐ স্বার্থবাহী প্রবণতা ও ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পায়।
অপরদিকে সংবেদনশীলতা কি, তা সম্ভবত সংবাদমাধ্যম ভুলেই গেছে। তারা নিজেদেরকে বাকি সবার নিয়ন্তা মনে করে। তাদের যেন কারোর কাছে কোন জবাবদিহির দায় নেই। তাই মাঝে মধ্যে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়, কীভাবে সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করা যায়, যাতে মানুষের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থা বুঝে তারা কাজ করবেন। প্রশ্ন আসে, তারা যে জবাবদিহি করবেন, সেটাই তো স্পষ্ট নয়।
এটাই আজ সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের বাস্তব চালচিত্র। এসব অনুকূল, প্রতিকূল, সমালাচনা ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এই প্রবাসে ১০ থেকে ১২টি নিয়মিত অনিয়মিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক প্রথম আলো তারই একটি। বয়সের দিক থেকে ‘প্রথম আলো’ই সম্ভবত কমবয়েসি। মাত্র সাত বছর। ইতিপূর্বে অনেক সাপ্তাহিক হারিয়ে গেছে। প্রথম আলো তার কর্মকাণ্ড নিয়ে টিকে আছে। কারণ সমাজের দায়বদ্ধতার প্রয়োজনে পত্রিকা পরিচালিত হয় বলে। পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যে করোনা প্যানড্যামিক বছর তিনেক সমাজকে একেবারে তোলপাড় করে ফেলে। পত্রপত্রিকা টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ পত্রিকা বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু ‘প্রথম আলো’ এই কঠিন সময়ে সমাজের পাশে দাঁড়িয়েছে। দুর্যোগ-দুর্ভোগের ঘটনা তুলে ধরে মানুষের নিকটবর্তী থেকেছে। এসব ঘটনা নিয়ে পত্রিকা সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী একটি বই লিখে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা পালন করেছেন বলা চলে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পত্রিকার অংশগ্রহণ ও ভূমিকা প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে।
নানা উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন মতের ও পথের সংবাদপত্রের মাঝে ‘প্রথম আলো’ প্রবাসী পাঠকদের বাস্তব জীবনের প্রতিফলন ঘটাবে এটাই পাঠক সাধারণের স্বাভাবিক চিন্তা ও প্রত্যাশা। নতুন দেশে নতুন সমাজ স্থিতিশীলতা অর্জনে যে অস্থিরতা বিরাজ করে, ‘প্রথম আলো’ তারই আলোকে পথ দেখাবে এটাই প্রত্যাশিত। সেই প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক প্রথম আলো কতটুকু অবদান রাখবে, তার ভূমিকা
কী হবে সেটাই হবে পত্রিকাটির ভবিষ্যত অগ্রগতি, উন্নতি ও সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের উৎস ও চালিকাশক্তি। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পত্রিকার অগ্রগতি ও বহুল প্রচার কামনা করি।
2-
ভিন্ন বসন্ত
সোনিয়া কাদির
লেখক
পৃথিবীতে মাতাল অশ্বকুল উড়িয়েছে তাদের ব্যাপক পুচ্ছরাশি। কত ভাবুক, সতত ডানায় ভর করে ঘর গড়েন লোক-কোলাহল পেরিয়ে অন্যতর এক লোক সমাগমময় অবিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠায়। কাব্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলে থাকতে পারে মাত্র ক'জন।পূর্ণ বিকাশের আগে নিভে যায় অনেক সম্ভাবনাময় আলোকশিখা ।
আমৃত্যু পাত্রে তুমি তৃষ্ণার জল। প্রিয় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার ষষ্ঠ বর্ষপূর্তির সুবর্ণ এই দিনটি গত হবার আগেই জড়াবে -মোড়াবে ইতিহাসের মাকড়সার আঠায়।
সমন্বিত এ উৎসব "শত ঝর্নার জলধ্বনী" হয়ে সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কপোতাক্ষকে ছেড়ে যে কষ্ট পেয়েছিলেন, আমার সেই কষ্টে প্রথম আলো নিউইয়র্ক; হয়েছে নিরাময় ক্যাপসুল।
ছয় বছর আগে যখন কবি সাহিত্যকদের প্রকাশ-হাওয়ায় এলোমেলো, ইতিউতি খণ্ড খণ্ড চেষ্টা প্রাণহীন অনুপভোগ্য, তখন দিনমণি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা-দরজা খুললো, তৈরি হলো এক রূপকথার সমাজ, যেখানে শিল্প ও সমাজ মিথুনীকৃত হয়ে ওঠে।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা-নামক ভাস্কর্যকে সংবাদ, শব্দ দিয়ে ঘষামাজা সাজগোছের কঠিন কাজ নিরবধি চলমান। তাতে কোন থেমে পড়ার গল্প নেই, ভাঙনের শব্দ নেই, আছে কেবলই সৃষ্টির কোলাহল আর সামনে চলার প্রত্যয়।
আলো নিয়ে জন্ম, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বলশালী। দ্রুত ধাবমান, তারপরে হার্ডসনে ছয়টি গ্রীষ্মে সিংহ দাপট দেখিয়েছে, ছয়টি কনকনে শীতে শুভ্র বরফের চাদর গায়ে ঋতুর সেতু পার হয়েছে। ছয়বার বৃক্ষসমাজ বৃদ্ধ হয়েছে আবার যৌবনপ্রাপ্ত ও হয়েছে। কিন্তু প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা-অদ্যাবধি অদ্বিতীয় খুঁটিকে শক্ত করে ধরেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা ওখানে দ্বিধাহীন মতপ্রকাশ করি, প্রয়োগ করি না। যুক্ত করি, খণ্ডন করি না। সৃষ্টি বিশ্বাসী বলেই ধ্বংসবিরোধী ভালোবাসা যতটুকু দেই, তার কয়েকগুণ বেশি ফেরত পাই। দ্বীপ যেখানেই জ্বলবে, দ্যুতি ছড়াবে। প্রথম আলোর প্রাণ পুরুষ ইব্রাহিম চৌধুরীর অবিরাম ও দক্ষ পরিচালনায় প্রথম আলো'র দীপ দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
শুরু থেকে একদল সাদা পায়রা প্রথম আলোর পরশ মেখে নিজেরা দীপ্যমান দীপাবলি হয়ে আলোটাকে আরো শানদার করে চলছে। কারো মাথার উপরে, আশেপাশে কোন কড়াকড়ি নেই আঁকাবাঁকা নেই। সবকিছু সোজাসুজি।
তারপর আর পর নেই, এই পথের যাত্রীরা সকলেই হয়ে আছেন পরষ্পরের আপন। প্রথম আলোর আবাস তাদের সকলের নিজের। এরা আজব দেশের ধন্য প্রজা- দেশজোড়ে এদের নাম। এরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
সৈয়দ মুজতবা আলী, বিশ্বভারতীর বাইরের প্রথম ছাত্র। তাঁর বয়স যখন সতেরো, তখন এম সি কলেজে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ "আকাঙ্ক্ষা" নামীয় বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতা শুনে সৈয়দ মুজতবা আলী কবির কাছে চিঠি লিখে
জানতে চান, আকাঙ্ক্ষা বড় করতে হলে কি করতে হবে? চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন, "স্বার্থশূন্য হয়ে কাজ করলেই আকাঙ্ক্ষা কে বড় করা যায়।"
আমার আকাঙ্ক্ষা ক্ষুদ্র, আমি সকলের সাথে মিলেমিশে যা উপভোগ করি তা সাহিত্য এবং সেই সাহিত্যের পাপড়িগুলো পরম আদরে বিছিয়ে দেই প্রথম আলোর পৃষ্ঠায়। নিষ্টাবান প্রথম আলো টিম আমাদের এলোমেলো পাপড়িগুলোকে সুবিন্যস্ত করে পাঠকদের সামনে পরিবেশন করেন।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সাফল্যে নিজের জন্য কিছু সুখকর স্মৃতি জমা হচ্ছে, পরবর্তী সময় তা হবে আমার আনন্দের উপকরণ। বর্ষপূর্তির আনন্দ দিনে প্রথম আলোর কলা কুশলী, পাঠক সহ সকলকে শুভেচ্ছা। আমার প্রত্যাশা প্রথম আলো দীর্ঘজীবী হোক। শুভ জন্মদিন।
3-
খবরের কাগজের উচিত জনমানুষের হয়ে ওঠা, ‘প্রথম আলো’ জনমানুষের হোক
কাকন রেজা
লেখক, সাংবাদিক
---------
‘কেন লিখি’ এ বিষয়ে আমার একটা লেখা ছিলো একটা সাহিত্য সাময়িকীতে। সেখানে যা বলেছিলাম তা মূলত সাহিত্য বিষয়কে কেন্দ্র করে। কিন্তু খবরের কাগজ বা মাধ্যমে
লেখার বিষয় কিছুটা আলাদা। বিশেষ করে উপসম্পাদকীয় লেখার বিষয়টি। সাহিত্যের লেখায় একটা ‘আমি’ থাকে, ‘ব্যক্তিগত’ একেবারেই গত হয় না। কিন্তু উপসম্পাদকীয় লেখা হয় দেশের জন্য, মানুষের জন্য। সেখানে লিখতে হয় ব্যক্তিকে অতিক্রম করে। ব্যক্তিকে গত করে। কখনো বা সে লেখা দেশের সীমানাকে অতিক্রম করে। ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এর কনসেপ্টে তা করতেই হয়।
প্রযুক্তি সারাবিশ্বের মানুষকে যূথবদ্ধ করেছে। সুতরাং লেখা সব-সময় একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করেই হবে তেমন কথা এখন অচল। ইউক্রেনে যুদ্ধ হলে তার জের পোহাতে হয় বিশ্বের সব মানুষকে। চীনের করোনা ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। লেখাও তেমনি ভূখণ্ডের সীমানা অতিক্রম করে, আর তা মানুষের প্রয়োজনেই। তাই লেখার স্বাধীনতাটা ভীষণ জরুরি। ‘প্রথম আলো’ উত্তর অ্যামেরিকাতে লেখার কারণটা তাই। এখানে লেখার স্বাধীনতা রয়েছে। সম্পাদক অযথা লেখায় বা’হাত মেলেন না। বলেন না, এটা লিখতে হবে, ওটা লেখা যাবে না। ওই লেখা আমাদের নীতির সাথে যায় না। মূলত নীতি বলতে এখন রাজনীতি। সব নীতি ক্রমেই রাজনীতিতে ঠাঁই নিচ্ছে বলেই আজকে দেশের অনেক খবরের মাধ্যম মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। এই হারানোর বিষয়টি আজ প্রকট। দৃশ্যমান এই প্রকটতা এখন আর অস্বীকার করার জো নেই।
স্বাধীন গণমাধ্যম বলতে যা বোঝায়, তার জন্য স্বাধীন মানুষ দরকার। পাওলো ফ্রেইরি বলেছিলেন, দাসত্ব থেকে মুক্তির মূল কথা হলো নিজের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি। স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য প্রয়োজন নিজের চিন্তার সীমাবদ্ধতা তথা দাসত্ব থেকে মুক্ত মানুষ। মতান্ধতা দাসত্বের অন্যতম কারণ। কোনো অন্ধ কখনো কাউকে পথ দেখাতে পারেন না। গণমাধ্যমের কাজ পথ দেখানো, আলোর পথ। সেখানের প্রধানরা অন্ধ হলে, গণমাধ্যম নিজেই অন্ধকারে পথ হারায়। অন্যকে আলোর দিশা দেখানো তখন অসম্ভব হয়ে ওঠে। আমরা ক্রমেই সেই অসম্ভবের পথে হাঁটছি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক দেখলেই বোঝা যায় কতটা অন্ধকার আমাদের ক্রমশ গ্রাস করছে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে আমাদের যে অহঙ্কার তা ক্রমেই ধসে যেতে বসেছে। তিনপায়া চেয়ারে বসে ভারসাম্য রক্ষা করাটা কঠিন। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের বেলাতেও। চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে গেলে কারো হয়তো মনে হতে পারে যে, যাক বাঁচা গেলো সমালোচনার হাত থেকে। বাঁচা কি সত্যিই যায়? যায় না। ইতিহাসের বিগত পাঠ তা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। কিন্তু ওই যে বহুল বলা কথা, ইতিহাসের পাঠ থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তবে আমাদের শিক্ষা নেয়ার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সময় ফুরোবার আগেই ঝরে পড়া শিশু না হয়ে পুনর্বার পাঠে ফিরে আসা উচিত। তাহলেই হয়তো সবার মঙ্গল।
যাকগে, শুরু করেছিলাম ‘প্রথম আলো’র বর্ষপূর্তি নিয়ে। কিন্তু অভ্যাসের দাস বলে কথা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলে ধানই ভানে। কী আর করা। আবারও বলি, ‘প্রথম আলো’ উত্তর অ্যামেরিকাতে লিখি, লেখার জন্য জরুরি স্বাধীনতাটুকু পাই বলে। দেশেও যেসব মাধ্যমে লিখি, সেখানেও সেটুকু পাই বলেই লেখা। যেখানে পাই না, সেখান থেকে হাত গুটিয়ে নিই। মনে মনে আবু সালেহ’র ছড়া ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না / বলা যাবে না কথা / রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা!’ উচ্চারণ করতে করতে চলে আসি। ‘প্রথম আলো’ উত্তর অ্যামেরিকা যতদিন সে স্বাধীনতা দেবে লিখে যাবো।
শেষে ‘প্রথম আলো’ উত্তর অ্যামেরিকার জন্য শুভকামনা। কাগজটি আরো বেশি করে জনমানুষের কথা বলুক, জনমানুষের হয়ে উঠুক।
4-
সাতটি তারার আলোয় উজ্জ্বল প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা
ভজন দত্ত
লেখক, কবি
--------------
বিদেশের মাটি থেকে আমাদের প্রাণের ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা বিজয়কেতন উড়িয়ে দূরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে যাওয়া বাংলা ভাষাভাষী সকল মানুষের এগিয়ে যাওয়া। আমরা বহুদূর থেকে খুশিতে ফেটে পড়তে পড়তে হাততালি দিচ্ছি, গর্বিত হচ্ছি । ইত্যবসরে ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে যুক্ত সব্বাইকে অশেষ শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। সেই সঙ্গে যাঁরা পত্রিকাটিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলতে সাহায্য করছেন তাঁদের সকলকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় আপনাদের নিরলস প্রয়াসে পত্রিকা যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে আগামী দিনের জন্য ভরসায় বুক বাঁধতে সাধ হয়।
আমি পশ্চিমবঙ্গের যে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করি, যেখানে আমার রুটি রুজি, সেটা মহানগর কলকাতা থেকে ২৩০ কিমি দূরে। না না, তারজন্য নিজেকে প্রান্তিকজন বলে কোথাও দাবি করি না। কোনোদিন কোনও 'কোটা' বা সংরক্ষণ, তাও চাইনি। কবির কথায়, 'এই বেশ ভালো আছি, খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি… '। পশ্চিমবঙ্গ মানে
কলকাতা নয়, বাংলাদেশ মানে শুধু ঢাকা নয় এই কথাটি জানেন অনেকেই। যাঁরা জানেন, এপার ওপার করেন তাঁরা জানেন, বাংলা ভাষার অপরূপ সৌন্দর্য গ্রামে, মফস্বলে।
বিশ্বে এখন বিশাল বিপুল অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব বলে কিছু নেই। পৃথিবীটা ছোট হতে হতে বোকাবাক্স হয়ে এখন হাতের তালুতে বন্দি। তালুর যন্ত্রটি, ভীষণ চালাক। সে কতকিছুই কেড়ে নিল পৃথিবীর! বোকাবাক্সটাও দেখতে দেখতে নীরব হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা চালাক যন্ত্রটি মুঠোয় নিয়ে ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীতে কদম কদম বাড়িয়ে, কোথায় যে চলেছি, কে জানে! এই পথের শেষ কি এ.আই. নামক যন্ত্রে? সে বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ ভাবুন।মানুষ যদি এখন কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো বলে ইচ্ছে করে, তবে সে অনায়াসেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। না হলে, কোথায় কোন সুদূর
আমেরিকা, আর কোথায় বাঁকুড়া! অন্তর্জাল ও অ্যান্ড্রয়েড পৃথিবীর মানুষদের এত কাছাকাছি নিয়ে এসেছে যে এখন দূর আর সুদূর ‘উত্তর আমেরিকা' নয়।
আমি যে বাঁকুড়ায় থাকি সেখানে আছে হিমালয়েরও আগের পাহাড়। আমাদের পাহাড়কে প্রকৃতি বানিয়েছে হাতির মতো দেখতে। নাম তার শুশুনিয়া। সেই পাহাড়েরই একটা গুহায় আছে বাংলা হরফে লেখা এক অখণ্ড শিলালিপি। গবেষকদের অনুমান এই শিলালিপিটি খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের। এখানে আমরা প্রাণের ভাষায় কথা বলি, হাসি, কাঁদি, প্রেম ও ঝগড়া করি। হ্যাঁ, পরকীয়াও হয় বৈকি! 'বাঁকড়ি' উপভাষার বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এ ভাষা মান্য বাংলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। পাঠক্রমে এর স্বীকৃতি নেই। অথচ এইসব উপভাষার ভেতর বাংলা ভাষার যে মাধুর্য পাওয়া যায় তার প্রমাণ আমরা পাই লালনের গানে, আমাদের সমৃদ্ধ বাউল ও লোকগীতিতে। 'বাঁকড়ি', 'চাটগাঁইয়া' এসব উপেক্ষার উপহার পেলেও, চর্যাপদের যুগ থেকে তবুও আমরা বাংলা ভাষার শিকড় আঁকড়ে আছি। এপার বাংলার রাজধানী মহানগরে গেলে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বললে অনেক সময় সব কাজ উদ্ধার করা যায় না। বেশ অস্বস্তি হয়। চারপাশে হিন্দির আগ্রাসন, অধিকাংশ বিপণন সংস্থা বা দোকানের নাম বিশুদ্ধ বাংলায় পাওয়া যায় না। অনেক সময় পথ জানার জন্য ভাঙাচোরা ইংরেজি, হিন্দির জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পরিত্রাণ পেতে হয়। বৃদ্ধ হচ্ছি বলে নাকি জানি না ঠিক, বর্তমান প্রজন্মের মুখের ভাষা শুনে এখন হাঁ করে থাকি! মুখে মাছি ঢুকে গেলেও সে ভাষা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের অ্যান্টেনায় ধরা যায় না। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, তার সঙ্গে পিএনপিসি, এমআইবি, ডিডিএলজে টাইপের কত মুণ্ডমাল শব্দ! বুঝতে পারি, আমাদের মতো আমাদের ভাষাও ভাঙছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিতে বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবী যখন একটি 'বিশ্বগ্রাম' হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে সেখানে মায়ের ভাষার এমত ভাঙনে কষ্ট হয় না যদি লিখি, তাহলে মিথ্যা লেখা হবে। খুব কষ্ট হয়। আর কষ্টের ভেতর গাঢ় অন্ধকারে আসে
আশার ‘প্রথম আলো’। উপভাষা নিয়ে ‘প্রথম আলো’ কিছু করলে, বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হবে।
5-
৭ম বর্ষে পদার্পণ-সংবাদপত্রে পাঠকের প্রত্যাশা
আফতাব চৌধুরী
লেখক
---------
উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত– ‘প্রথম আলো’ বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় পত্রিকা, আজ তার জন্মদিন। আজকের এ শুভদিনে এ পত্রিকার সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা, নির্বাহী সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, কলাকুশলী ও পাঠকদের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে প্রিয় এ পত্রিকার অগ্রাযাত্রা কামনা করছি। প্রত্যাশা করছি পত্রিকাটি যেন দৃঢ়প্রত্যয়ে সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে চলে সামনের পানে।
‘প্রথম আলোর’ আমি একজন লেখক, দীর্ঘদিন থেকে এ পত্রিকায় আমার লেখা গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়ে থাকে। কিন্তু আমি আজ পাঠক। পাঠক হয়েই প্রশ্ন করছি সংবাদপত্রে কী পড়তে চাই? কী জানতে চাই? এর চেয়ে সহজ প্রশ্ন আর কি হতে পারে। তবু অনেক সময় সহজ প্রশ্নের উত্তর লেখাই দুরূহ হয়ে পড়ে। চট করে যদি জবাব দিতে হয় তাহলে বলবো সংবাদপত্রে দেশ-দুনিয়ার খবর পড়তে চাই। কোথায় কী ঘটছে তা জানতে চাই। কিন্তু সবসময় জানতে পারি কি?
জানতে পারি ততটুকুই যতটুকু সাংবাদিকরা দয়া করে আমাদের জানান দেন। তাতে সব সময় আমাদের কৌতুহল নিবৃত্ত হয় না। আমরা অনেক কিছু জানতে চাই। কিন্তু জানতে পারি সামান্যই। এক্ষেত্রে অনুমান করতে পারি সাংবাদিকদের সীমাবদ্ধতা আছে, কিংবা আমরা যা জানতে চাই পত্রিকার মালিক তা আমাদের জানতে দিতে চান না। সেখানে কর্মরত সাংবাদিক শত চেষ্টা করলেও তা আমাদের জানাতে পারবেন না। এটাও একটা বাঁধা। পাঠকের চাওয়া পাওয়া আর পত্রিকার নীতিমালার মধ্যে যদি ফারাক থাকে তাহলে পাঠক অনেকক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়। কাজেই পাঠকের এই পরিস্থিতি মেনে নিতেই হয়।
খুব সুক্ষ্মভাবে দেখলে আজকাল নিরপেক্ষ সংবাদপত্র বলতে কিছু পাওয়া যাবে না। প্রায় প্রত্যেক পত্রিকাই একটা বিশেষ দল, মত বা গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এটা যখন পত্রিকার অঘোষিত নীতি, তখন পাঠক যা চায় তা কি পত্রিকার পাতায় তেমন করে পায়? পাঠকরাও অবশ্য আজকাল সচেতন হয়ে উঠছেন। যাঁরা নানা দল, মত ও পথের সমর্থক, তাঁরাও বেছে বেছে তাঁদের মনপছন্দ পত্রিকাটি কিনে থাকেন। যাতে বেশি হতাশ হতে না হয়।
রাজনৈতিক ঘটনা পত্রিকাগুলো তার সুবিধামত রিপোর্ট করে থাকে। একটা স্বতঃসিদ্ধ বা জনসমক্ষে ঘটিত ঘটনাও দলীয় কাগজ তার দলের স্বার্থ রক্ষা করে রিপোর্ট করে। এসব ক্ষেত্রে লাজলজ্জারও বালাই নেই। পাঠকও তা মেনে নিয়েছেন। আজকাল দেশের অনেক কিছুই যখন দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয় তখন সাংবাদপত্রের কাছেই বা আমরা সুবিচার ও নিরপেক্ষতা আশা করবো কেন? সাংবাদপত্রের মালিক বা সম্পাদকও তো এই সমাজের মানুষ। তাঁকেও সমাজের অন্য দশটা কাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তবে ‘প্রথম আলো’ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে। এ পত্রিকাটি সংবাদ প্রচারে নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য প্রশংসিত।
অবশ্য প্রবীণ পাঠক বলতে পারেন, ‘সংবাদপত্র তো আলাদা একটি সম্মানিত প্রতিষ্ঠান। তাকে রাষ্ট্রের “চতুর্থ স্তম্ভ” বলা হয়। সাংবাদিক বা সম্পাদককে সমাজে বিশেষ সম্মানের
সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করি।’ খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু যদি সবিনয়ে বলি বাংলাদেশের সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সম্পর্কে সাধারণভাবে আজ কী আর এত বিশেষণ ব্যবহার করা যায়? সংবাদপত্রের চেহারা দেখে বোঝা যায় আজ সার্বিকভাবে সাংবাদিকতার অবস্থান কোথায়।
খুব সংকোচের সঙ্গে বলতে পারি, সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সমাজ আজ সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই নিজেরা কোন স্রোত সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন না। কারণ এখন বাজার অর্থনীতি আর প্রতিযোগিতার যুগ। কাজেই ভিন্ন স্রোত সৃষ্টি করতে গেলে যদি পিছিয়ে পড়তে হয়, তাই এই ঝুঁকি কেউ নিতে রাজী নয়। কেউ রাজী নয় একথা বলাও বোধ হয় ঠিক হবে না। গেল ক’বছরে নতুন যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে, লক্ষ্য করেছি, তাঁদের মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব রয়েছে। গতানুগতিকতার বাইরে যাবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন, কী জানতে চাই? জানতে চাই তো অনেক কিছু। কিন্তু জানতে পাচ্ছি কোথায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম রিপোর্টাররা এক ধরণের গোয়েন্দা। কিন্তু সেই ‘গোয়েন্দাগিরির’ পরিচয় পাচ্ছি কোথায়? আজকাল খবরের কাগজে তদন্তমূলক রিপোর্টের খুব অভাব লক্ষ্য করি। অথচ পাঠক হিসেবে জানতে চাই কেমন করে এটা ঘটল? কারা এসব কাণ্ড করল? কিন্তু কোথায় সে রকম রিপোর্ট? খবরের কাগজ পড়ে মাঝে মাঝে মনে হয় মুখপাত্র বা প্রত্যক্ষদর্শী যতটুকু বিবরণ দেন সাংবাদিক সাহেবরা ততটুকু বিবরণ পাঠকের কাছে পৌঁছান। অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্টার আর একটু এগিয়ে গিয়ে খবর সংগ্রহ করতে চান না বা খবরের পেছনের খবর তুলে আনতে চান না। মনে হয় তিনি ‘কেঁচো’ খুঁড়তে চান না, এই আশংকায় , যদি ‘সাপ’ বেরোয়! অথচ আমাদের ধারণা, ‘সাপ’ বের করাই রিপোর্টারের কাজ। সমাজের অলিতেগলিতে যে সব ‘সাপ’ লুকিয়ে আছে সেগুলো বের করে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারলে পাঠক হিসেবে আমরা তৃপ্তি পেতাম।
সংবাদপত্রে চোর ডাকাতের খবর থাকে। এমনকি ছবিও। তার তুলনায় কৃতি লোক, গুণীলোকের খবর থাকে কম। এমনকি অনেক গুণীলোকের ছবি ছাপা হয় মৃত্যুর পরে। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের যত খবর ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হয় তার সবটুকু গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুনও নয়। ‘খবর’ হবার উপযুক্ত নয় অথচ কী এক মোহের বশে বা পাঠকের চাহিদা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনাবশত পত্রিকাগুলো রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বিস্তর লেখা ছাপায় যা প্রায় সময় ক্লান্তিকর ও পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। এ ব্যাপারে খুব দ্বিমত হবে না যে, আমাদের দেশের রাজনীতির মান খুব উঁচু নয়। চিন্তাশীল, শিক্ষিত ও কর্মোদ্যোগী ব্যক্তির সংখ্যাও রাজনৈতিক অঙ্গনে কম। আমরা নানা কারণে অনেককে নেতার আসনে বসাই বটে, কিন্তু সত্যিকার নেতা হওয়ার গুণাবলী অনেকের নেই। সংবাদপত্রগুলো এসব কৃত্রিম নেতাকে এমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরে যে তাতে সমাজ বিভ্রান্ত হয়। এমনকি ‘নেতাও’ বিভ্রান্ত হয়ে নিজেকে কেউকেটা হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। সংবাদপত্রের রয়েছে একটা অদ্ভুত শক্তি। তার প্রকাশগুণে সাধারণও ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠে। পাঠক হিসেবে এটা আমি আশা করি না। আমার প্রত্যাশা, সংবাদপত্র ব্যক্তিকে তার গুণপনা, অবদান, ভূমিকা ইত্যাদি দিয়ে বিচার করবে বা বিচার করবে ঘটনার পটভূমিতে কিংবা বক্তব্যের ওজন দিয়ে। এর বাইরে যারা তারা সাধারণ। কোন কোন সময় পদের কারণে কাউকে কাউকে গুরুত্ব দিতে হয় বটে। কিন্তু তারও একটা আকৃতি থাকা উচিত। সংবাদপত্র যদি ভালো মানুষ, ভালো কাজ, অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত ব্যাপকভাবে তুলে ধরে তাহলে সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আমাদের সংবাদপত্র এখনও নেতিবাচক ঘটনার প্রতিই বেশী আগ্রহী। গুণ্ডা, বদমাশ, খুনি, হাইজ্যাকারের ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় যত ছাপা হয়। ভালো বা গুণীলোকের ছবি তত ছাপা হয় না। এরশাদের ছবি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় যতবার ছাপা হয়েছে অধ্যাপক আবুল ফজল বা দেওয়ান আজরফের ছবিও এতো ছাপা হয়নি। এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজের যেখানে সামান্য ভাল কাজ
হচ্ছে , উৎপাদন হচ্ছে, রপ্তানি হচ্ছে, নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে, নতুন কিছু আবিস্কার হচ্ছে তাকে তুলে ধরতে হবে নিষ্ঠার সাথে। আর একই সঙ্গে খারাপ জিনিসও তুলে ধরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে। বলতে হবে এটা অন্যায়। এটা নিন্দাযোগ্য। সংবাদপত্রের সম্পাদক প্রকাশক যদি পাঠকের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে চান তাহলে পত্রিকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে নতুন করে ভাবা দরকার। দশ বা পঞ্চাশ পৃষ্ঠার পত্রিকায় বহু কিছু বাদ দেয়ার মতো থাকে, আবার নতুন কিছু সংযোজনেরও অবকাশ রয়েছে। প্রতিটি পত্রিকা চাইলে পাঠক চাহিদা জরিপ করতে পারেন। প্রতি দু’বছর অন্তর পাঠক চাহিদা জরিপ করে পত্রিকার পরিকল্পনা ও বিষয়বস্তু পুনর্বিন্যাস করা যায়। আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, পত্রিকা তো আসলে পাঠকের জন্যেই।
6-
প্রথম আলো, নিউইয়র্ক: বৃত্তভেদী সংবাদপত্র
শেখর ভট্টাচার্য
লেখক, কবি
-------------
বাংলাদেশের বাইরে বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে ছোট-বড়, প্রাণবন্ত বাংলাদেশ। এসব দেশে বাঙালি জনসমাজ ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নুতন নুতন কেন্দ্র। 'মাহীনের ঘোড়া গুলো'-ব্যান্ডের গানের কথার মতো-'পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/স্যাটেলাইট আর কেব্লের হাতে/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী।'
পরের স্তবকের শেষ দুটো চরণ’তো অসাধারণ, 'যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে/ঘুচে গেছে দেশ কাল সীমানার গণ্ডী'
সত্যি ঘুচে গেছে দেশ, কাল, সীমানার যত গণ্ডি। পরিবারের সদস্যরা ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো কেউ লন্ডন, কেউ নিউইয়র্ক, কেউ ক্যালিফোর্নিয়া। কোন কোন পরিবারের সদস্যরা আছেন ইউরোপের দেশে দেশে। প্যারিস, বন, রোম এখন বাংলাদেশের হৃদয়ের বর্ধিত অংশ। পরিবারগুলো যখন ছড়িয়ে যাচ্ছে ভূগোলকের এধার ওধার, পরিবারের সাথে যাচ্ছে উৎসব, আনন্দ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। বাঙালি প্রবাসী হলে সংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হয় বেশি। সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায়, সন্তানরা যদি শেকড় ছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর থাকলো বা কী? তাই প্রয়োজন নববর্ষ পালন, বসন্ত উৎসব, শরৎ বন্দনা, নবান্ন উৎসব।
বাঙালির এই বাঙালিয়ানাকে পরিপুষ্ট করে তুলতে, জনসমাজের কাছে তথ্য, বিনোদনের মাধ্যমে সৌহার্দ্য তৈরিতে প্রয়োজন সংবাদপত্রের। গত সাত বছর ধরে একটি সংবাদপত্র ধীরে ধীরে সেই কাজটি করে যাচ্ছে। দিন দিন এই সংবাদপত্রটি জনসমাজের সহায়তায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠান কথাটি বড় মাপের তারপরও নিজের পর্যবেক্ষণের প্রতি আস্থা রেখে উচ্চলয়ে কথাটি বলে ফেললাম। একটি সংবাদপত্র যে খুব কম সময়ে প্রতিষ্ঠানের মতো সেবা দান করতে পারে, তা’ প্রথম আলো-নিউইয়র্কের ভূমিকা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে উপলব্ধি করা কঠিন। প্রথম আলো-নিউইয়র্কের বয়স যখন এক বছর ছয়মাস, তখন থেকেই নিবিড়ভাবে সঙ্গী হয়েছি। সাড়ে পাঁচ বছর ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলে অনেক কথাই বলা যায়। মনের গহীনে সঞ্চিত সব কথা পাঠকের সাথে ভাগ করার স্পেস সম্পাদক আমাকে দিতে পারবেন না, তাই চুম্বক কথার কিছু অংশ ভাগ করে নিচ্ছি।
প্রথম আলো, নিউইয়র্কের অধিকাংশ লেখক, সাংবাদিক, প্রদায়ক, বিভাগীয় সম্পাদক অবস্থান করেন নিউইয়র্কে। আমি বাস করি ঢাকা শহরে। নিয়মিত লেখক হিসাবে সম্পাদক এবং তার তারুণ্যমণ্ডিত দল কখনো মনে করেন না আমি দূরে আছি। প্রথম আলোর যত ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠান হয়েছে আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। অধিকাংশ সংবাদকর্মী
এবং লেখকদেরকে সাথে আমার সরাসরি পরিচয় নেই কিন্তু তারা আমাকে এতই আপন করে নিয়েছেন যেন পাশাপাশি টেবেলে বসে কাজ করা সহকর্মী। এই ভার্চ্যুয়াল যুগে মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে এ’ভাবেই বোধহয় আত্মার অংশ হওয়া সম্ভব হয়।
“যৌবন-তারুণ্য” বিষয়টি সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। কথাটি বলেছিলেন চিরযৌবনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তারুণ্য বিষয়টি মনের। যৌবনের তারুণ্যের ছায়া যদি সৃষ্টিশীল কর্মে প্রতিফলিত না হয়, তাহলে সৃষ্টিশীলতা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। প্রথম আলো নিউইয়র্কে তারুণ্যের প্রতিফলন আছে। সংবাদ পরিবেশনায়, অভিমত উপস্থাপনায়, সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগে এই তারুণ্য আমি দেখতে পাই। উত্তরের নকশা, বিভাগটির উপস্থাপনা যে কোন পাঠক কে মুগ্ধ করবে। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন নকশার প্রতিটি সংখ্যা। বিষয়বস্তু, ছবি, অলংকরণ যেমন উচ্চমানের ছাপাও তেমন ঝকঝকে। যারা শুধু লেখালেখিতে তারুণ্য আছে শুনে অপরিপক্কতার কথা চিন্তা করবেন কিংবা নাক কুচবাবেন তাদের জন্য বলছি, প্রথম আলো, নিউয়র্কের প্রতিটি সংখ্যায় তারুণ্যের সাথে আছে গভীর বোধের সম্মিলন। এই সমন্বয়, সম্মিলনে পত্রিকাটি সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে হয়ে উঠছে গ্রহণীয়। প্রথম আলো নিউইয়র্কের টার্গেট পাঠক কারা? অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায়। প্রযুক্তির কারণে এখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বাঙালি এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রটি পাঠ করে থাকেন। বিষয়টি টের পাই, আমার বিশ্বাস আমার মতো অন্যান্য লেখক, সাংবাদিক এবং স্বয়ং সম্পাদকও বিষয়টি অনুভব করেন। আমি গড়ে প্রতি মাসে দুটো লেখা প্রথম আলো নিউইয়র্কে লিখে থাকি। লেখা প্রকাশের পর পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশের অনেক কোন থেকে বাঙালি পাঠকেরা আমার সাথে যোগাযোগ করেন, তাদের ভালো লাগার কথা জানান। আশ্চর্য হয়ে যাই প্রথম আলোর মান এবং উচ্চ প্রযুক্তির কারণে পত্রিকাটিকে যখন দেখি দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। নিঃসন্দেহে সম্পাদক এবং তার দলকে কুর্নিশ জানাতে হয়।
এবার ফিরে আসি প্রতিষ্ঠানের কথায়। প্রথম আলো নিউইয়র্ক, সংবাদপত্র হিসাবে শুধু প্রবাসী বা স্বদেশী বাঙালিদের সংবাদ পরিবেশন এবং অন্যান্য বিভাগের মাধ্যমে পাঠকের সংবাদ ও বিনোদনের ক্ষুধা মিটিয়ে শুধু প্রথাগত দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে না। বৃত্তের বাইরে আমরা দেখি নিয়মিত পদচারণা সংবাদপত্রটির। এই পদচারণার ফলে কী হচ্ছে-নানা রকম সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে প্রথম আলো নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের বাঙালি জনসমাজ প্রথম আলোকে ঘিরে নানাভাবে একত্রিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় অভিনেতা, গায়ক, গায়িকা, চিত্রপরিচালক, কবি, সাহিত্যিক, চিন্তক সকলেই যখন নানা কাজে নিউইয়র্ক যান তখন তাদেরকে ঘিরে দেখি প্রথম আলো কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে নানা আয়োজন। এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন না করলেও চলে; প্রথম আলো নিউইয়র্ক জনসমাজকে প্রবাসে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনো