https://voiceofpeople24.com/
3891
opinion
প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৩৬ | আপডেট : ৩০ নভেম্বর -০০০১ ০০:০০
বর্ষার আগমনে মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে ক্ষীণাঙ্গী কাস্তের মতো বাঁকা একফালি চাঁদ মাটির পৃথিবীতে নিয়ে এল খুশির ইদের খোশ-আমদেদ। একটুকু চাঁদের ওই মৃদু রোশনাই ধরার বুকে বার্তা ছড়িয়ে দিল-প্রেম-প্রীতি আর মহামিলনের।
প্রবহমান মহাকালের রথের চাকায় আবর্তিত হয়ে বছর পরিক্রমায় বিশ্ব মুসলিমের দুয়ারে আবারও ফিরে এসেছে ঈদ-উল-ফিতর। রমজানের সুদীর্ঘ ত্রিশটি দিনের সিয়াম সাধনার অবসান ঘটিয়ে শাওয়ালের চাঁদের ইঙ্গিতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আজ আনন্দে উতলপারা। খুশির ঈদের এই নওরোজে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আজ পাগল পারা। ঈদ এসেছে। বছর ঘুরে ঈদ এসেছে। ঈদ এসেছে ছোট্ট সোনামণির উচ্ছ্বল হাসিতে ভরা আধো আধো মুখের বুলিতে। ঈদ এসেছে বৃদ্ধ গফর মিয়ার শ্বেতশ্রভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত ফোকলা দাঁতের মিষ্টি হাসিতে। ঈদ এসেছে লাল টুকটুকে শাড়ি আর নোলকপরা কিশোরী আমিনার স্বপ্নিল দুটি কালো চোখের তারায় ঝিলিক মেরে।
ঈদ এসেছে ভরাযৌবনা নদীর মাঝে পালতোলা নৌকায় মাঝিমাল্লার ভরাট গলায় ভাটিয়ালী সূরে। দিগন্তপ্রসারী সবুজ কচি পাতায়, হলুদ সূর্যে ক্ষেত আর লাউমাচার উপর দিয়ে দখিনা হাওয়ায় হিল্লোলিত সোঁধা সোঁধা গন্ধ নিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া দীনমজুর কালু মিয়ার মেটো ঘরের আঙ্গিনায় আজ ঈদ এসেছে। কবির ভাষায় তাই তো আজ মন বলতে চায়-
বিশ্ব জেগেছে মুখের আনন্দে প্রাণের সে উল্লাসে, / ঈদের খুশির সুরভী ছন্দে, নিখিল ধরণী হাসে।/ সাগর-ভূধর, নদী-জলধারা, সে খুশিতে আজ সবই মতোয়ারা,/ দখিনা মলয় দোলা দিয়ে যায় শ্যামল দূর্বা ঘাসে।/ ভোরের আকাশে আলোর দীপালী,/ ফুলের জীবনে অলির মিতালী,/সূরের সে উচ্ছ্বাসে।
ঈদ-উল-ফিতর। তুমি আমাদের হাজার মোবারকবাদ গ্রহণ কর। তুমি স্বর্গের নন্দনকানন থেকে সুবাস নিয়ে এসেছো সত্যি, কিন্তু কোথায় এসেছো? অশান্ত, অস্থির, হিংসা, দ্বন্দ্ব, স্বার্থ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, কুটিলতায় ভরা পাপপঙ্কিল এই পৃথিবীতে, তাই না? না, এহেন পরিস্থিতিতেও তোমায় আমরা ফিরিয়ে দেব না। তুমি না এনেছো শান্তি আর মহামিলনের বাণী, এনেছো সাম্য আর মৈত্রীর বারতা।
‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,/ কত বালুচরে কত আঁখিধারা ঝরায়ে গো,/ বরষের পরে আসিল ঈদ।’ হে স্বর্গের সুরভীমাখা কুসুম। তোমায় কি দিয়ে আজ আমরা আবাহন করবো? সবকিছু পেয়েও আজ আমরা রিক্ত, নিঃস্ব, শূন্য।
আল্লাতে যার পূর্ণ ইমান, কোথা সে মুসলমান? হ্যাঁ, আমরা আজ ক’জন সত্যিকারের মুসলমান? আজ আমরা বিশ্বমানবের মুক্তিকারী মহানবীর দেখানো পথ থেকে কত দূরে সরে এসেিেছ। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে, বর্ণ, ভাষা, ধর্ম বিদ্বেষের হীনম্মন্যতায় আজ আমরা অতল অন্ধকারে ডুবতে বসেছি। তবু তোমায় ফিরিয়ে দেব না। তুমি না এনেছো স্বর্গের আলোকচ্ছটা। মোবারক হো ঈদ মোবারক।
‘সপ্ত আকাশ পারের থেকে/এলরে আজ খোশ খবর/দিল দেখা, সেই অদেখা/খোদ সুরাতের রোজ হাশর।’ ঈদ-উল-ফিতর। ইসলাম ধর্মালম্বীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসব। ঈদ-উল-ফিতর হল আরবি শব্দ। ঈদ অর্থ হল খুশি, ফিতর অর্থ হল দান। দানের উৎসব এই ঈদ-উল-ফিতর। সাম্যবাদের মহান আদর্শে গড়া ইসলাম ধর্মের পাঁচটি অবশ্য করণীয় কাজের একটি হল যাকাত। এই যাকাত দেবার নির্দেশ রয়েছে শুধু অর্থবানদের উপর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ ভোগ করার, ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপচয় করার অধিকার ইসলাম এইসব বিত্তবানদের দেয়নি। তুমি ধনী-তোমার প্রচুর ধন রয়েছে, তাই বলে তুমি উদরপূর্ণ করবে, আর তোমারই নিরন্ন, উপবাসী প্রতিবেশী একমুঠো অন্নের অভাবে ভুখা মরবে? তুমি জরি-চুমকির নতুন রেশমি জামায় বিভূষিত হয়ে ঈদের খুশি লুটবে; আর শতছিন্ন, চীরবস্ত্র পরিহিত তোমার গরিব প্রতিবেশী এক টুকরো কাপড় গায়ে জড়াতে পারবে না-না, তা হয় না। সে বিধান ইসলাম দেয়নি। ধনী-দরিদ্রের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে, সমতা আনতে তাই অমোঘ নির্দেশ-যাকাত দাও।
‘দে যাকাত, দে যাকাত, তোরা দে যাকাত,/ তোর দিল খুলবে পরে ওরে আগে খুলুক হাত।’ তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে তুমি সামান্য কিছু বিলিয়ে দাও নিরন্ন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন প্রতিবেশীদের। ঈদের দিনের খুশিতে তোমার সঙ্গে সেও ভাগিদার হোক। ক্বোরআন তাই তো বলেছে-‘যে ব্যক্তি নিজ প্রতিবেশীকে অভূক্ত রেখে নিজের উদর পূর্ণ করে সে মুসলমান নয়।
ঈদ নির্মল হাসিখুশির দিন, আনন্দের দিন। উৎসবের নামে উচ্ছৃঙ্খলতার আর অশালীনতার দিন নয়। ঈদ হল সবার সঙ্গে কোলাকুলির দিন। ধনী-নির্ধন, বাদশা-ফকির, সাদা কালো সবাই আজ এক মনের, এক প্রাণের, এক সমাজের এই উৎসবের অংশীদার।
‘জানো আজি সার, মানুষের কাছে মানুষের ভেদ নাই;/ এক আদমের সন্তান সবে, সবাই সবার ভাই।/ বঞ্চিত জনে দাও অধিকার, করো গলাগলি হও একাকার,/ সবার কন্ঠে বাজুক আবার একমুঠো সঙ্গীত।’
সুদীর্ঘ ত্রিশটি দিনের সিয়াম সাধনা আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধির যে শিক্ষা তারই স্বর্তস্ফূর্ত প্রকাশ এই মহামিলনের উৎসব। পূতপবিত্র আনন্দঘন এই দিনটিতে প্রতিটি মানুষ শপথ নিক-স্বার্থ আদায়ের নয়, স্বার্থ ত্যাগের। মিথ্যাচার আর স্বজনপোষণের নয়-সদাচার আর পরহিতের। উৎপীড়ন আর উশৃঙ্খলতার নয়-মমতা আর শৃঙ্খলতার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা বিদ্বেষের নয়-এক জাতি, এক প্রাণ আর একতার।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) শান্তি আর সাম্যবাদের মহান আদর্শকে সামনে রেখে এসো পূণ্যদিনটিতে সবাই জাতি ধর্ম বর্ণ ভাষার সংকীর্ণ পরিসর ছেড়ে চলুন আমরা হাতে হাত, বুকে বুক মিলিয়ে বিশ্বপিতার অনুপম এই সৃষ্টির সীমাহীন মুক্তাঙ্গনে একাকার হয়ে যাই। আমাদের সবার মন আর প্রাণ হয়ে যাক একাকার। আত্মত্যাগ, প্রেম আর কল্যানের সিঁড়ি বেয়ে পাপপঙ্কিল এই মাটির ধরায় স্বর্গের ফিরদৌস নিয়ে বারবার ফিরে আসুক-মিলনের উৎসব, আত্মসংযম, আত্মত্যাগের, সংযমের, বিলিয়ে দেবার উৎসব, কল্যাণের উৎসব, ঈদ-উল-ফিতর।