https://voiceofpeople24.com/
4001
lifestyle
প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১০:২২ | আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১০:৩৬
একজন সম্পাদক ইতোমধ্যে তৈরি করা একটি লিখিত পণ্য পোলিশ করেন। একজন লেখক বইয়ের ধারণার সাথে নিজ বিকাশ ঘটান এবং লেখেন। ইতিহাসে এমন কিছু যাদুকর আছেন, যারা একই সাথে ছিলেন সম্পাদক এবং লেখক। এর প্রধান একটি উদাহরণ হলো- টনি মরিসন। আমাদের চারপাশে এমন আরো কিছু উদাহরণস্বরুপ ব্যক্তি রয়েছেন যারা একই সাথে সম্পাদক এবং লেখক। আলী সিদ্দিকী তাদেরই একজন।
সাহিত্যের ওয়েবজিন- মনমানচিত্রের সম্পাদক হলেন আলী সিদ্দিকী। মনমানচিত্র-ইতোমধ্যেই দেশ-বিদেশে আমাদের সকলের প্রিয় একটি সাহিত্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। আলী সিদ্দিকী এমন একজন লেখক, যিনি সাহিত্য শিল্প এবং সৃজনশীল লেখার জন্মদিতে বিভিন্ন ধরন এবং কৌশলের লিখিত শব্দগুলির ব্যবহার খুব যত্নের সাথে গেঁথে নেন তাঁর কবিতা ও অন্যান্য লেখায়।
একজন 'কবি আলী সিদ্দিকী'র সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে হলে বলতেই হয়, তিনি মানুষের মৌলিক মানবিক সংগ্রাম আবহে কবিতা ও কথাশিল্পের ভুবনে বিচরণ করেন। শেকড়ঘনিষ্টতা, জাগৃতি, বোধ আর মননের নিগূঢ়তায় গড়ে তোলেন কাব্যবোধের জীবনসম্পৃক্ততা। মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিচিত্র সম্পর্কের গ্রন্থি- আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক মানবিকমূল্যবোধ, প্রাত্যহিক জীবনের দ্বান্দ্বিকতা তার লেখনীর প্রতিপাদ্য বিষয়। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জটিল ও দুঃখময় জীবনসংগ্রাম তার গদ্যের জিয়নকাঠি। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা, অন্ধত্ব আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে এবং প্রগতিশীল মানবিক মুক্তচিন্তারসপক্ষে সোচ্চার তার লেখনী। সুদীর্ঘ সময় মুক্তবুদ্ধির চর্চায় সম্পৃক্ত থাকলেও প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনি বরাবরইপ্রচারবিমুখ।
আলী সিদ্দিকীর একটি কবিতা "প্রতিপক্ষ হয়ে উঠি"-আমাকে ভীষণ নাড়া দিযেছে। আমি বিশ্বাস করি, লেখক যে ভাবমূর্তিতে কিছু একটা রচনা করেন, পাঠক সব সময় তার সঠিক বা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হোন না। তবু পাঠক হিসাবে আমরা সেটাকেইতিবাচক ভূমিকায় নিজ মতো বিশ্লেষণে টানতে পারি। ক্ষুদ্রজ্ঞানে আমার এমনই একটি চেষ্টা আজ।
"প্রতিপক্ষ হয়ে উঠি"-কবিতায় তিনি লিখেছেন,
"যে সন্ধ্যেটা এখন লালচোখে এগিয়ে এলো
ছড়িয়ে দিলো জাঁহাবাজ অন্ধকার চারদিকে
মটকে দিলো প্রাণবন্ত রোদেলা দিনের ঘাড়
আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছি।"--
স্বচ্ছ সোনালি দিন শেষে সন্ধ্যা এগিয়ে এলো 'লালচোখে'-যা হিংস্রতা বা ক্ষোভের প্রতীক আর 'সন্ধ্যা'-শত্রু বা প্রতিপক্ষ ছড়িয়েদিল 'জাঁহাবাজ অন্ধকার' চারদিকে- অর্থাৎ কূটবুদ্ধি ছড়িয়ে পড়েছে কবির চারপাশে, মটকে দিচ্ছে প্রাণবন্ত রোদেলা দিনের ঘাড়অর্থাৎ চারপাশের অরাজকতা ধ্বংস করতে চাচ্ছে মানুষের শক্তি, সতত মনন, অথচ তখনো কবি জেগে উঠছেন তীব্র প্রতিবাদে, হয়ে উঠছেন প্রতিপক্ষ-'আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছি।'
"এমনিতে আমার জমিনের মাটি সেঁতসেঁতে বহুকাল ধরে তার হাঁড় মজ্জায় পচন ধরেছে অসুস্থ ফলনে মন-মগজ হয়েছে আগাছাময়।"-- হয়তো কবি এখানে সময় ও বয়সের সাথে মন ও শরীরের ক্ষয় বা লড়াই করার শক্তি, ধৈর্যহীনতার কথা বলতে চেয়েছেন।
"মনোরম সন্ধ্যেরা উপভোগ্য রঙিন পেয়ালায়
বহুরূপী মুখোশধারী জমকালো রম্য উল্লাসে
অন্ধকারে মাংসাশী হয় দাঁতাল মানুষের দল
আমি দানব প্রহরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠি।"--
বহুরূপী মানুষদের নিয়েই এই সমাজ, এই বিশ্ব। যে প্রিয় মুখ আলিঙ্গলে গতকাল ভালোবাসা দেখিয়েছিল, সে-ই আজ সুযোগবুঝে পিঠে ছুড়ি বসাতে তৎপর হবে। এ কেবল ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নয়, সমাজ থেকে সমাজ, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, বিশ্বাস থেকে বিশ্বাস, দেশ থেকে দেশ সর্বত্রই চলে দখলদারিত্ব। চলে মানুষের অস্তিত্ব, বিশ্বাস, সংস্কৃতি বিলুপ্ত করে দেয়ার প্রচেষ্টা। কবি তবু সামনে বাড়তে পিছ পা হোন না, সাহস নিয়ে দানব প্রহরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন।
"আমার মাটিতে মেশানো আছে রোদের বীজ
অনন্ত সূর্য ফোয়ারা সঞ্চিত আছে গোলাঘরে
আছে শতাব্দীর সেরা রক্ত জমাট পাটাতন।"--
রোদের বীজ, গোলাঘরে, রক্ত জমাট পাটাতন-অন্যায় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কবির হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি করে, একটি আওয়াজ যাসমাজ ও বিশ্বের কাছে পৌঁছায়।
"তুমি জানো কারা ছড়িয়েছে অন্ধকারের বিষ
কারা কোষে কোষে পুঁতে দিয়েছে চির বন্ধ্যাত্ব
তোমার কসম প্রিয়তম শপথ আমার মাটির
আততায়ী অন্ধকারের আমি প্রতিপক্ষ।"--
আততায়ী অন্ধকারের বিরুদ্ধে কবি মাটির শপথ নিচ্ছেন। কী সেই আততায়ী অন্ধকার? কাকে রক্ষা করবেন বলে? দেশমাতৃকা? সমাজ-সংস্কৃতি, কিংবা ব্যক্তিসত্তা?
তাঁর লেখা এমন অসংখ্য কবিতা রয়েছে, যা পড়তে পড়তে মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। একবার নয়, একাধিকভার পড়তে হয়।পাঠক হিসাবে তাঁর কবিতা আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে, ভাবনায় ফেলে। তাঁর লেখা প্রতিবাদী কবিতাগুলো আমাকে নতুন করেভাবায়, নতুন করে জাগিয়ে তোলে। আলী সিদ্দিকী প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিয়মিত একজন লেখক ও কবি। উত্তরেরসাহিত্য, কবিতার এক পাতা-প্রায়ই তিনি সুষমামণ্ডিত করেন শৈল্পিক ঘ্রাণে।
আলী সিদ্দিকীর আরো একটি কবিতা "মাৎসোন্যায়"-
খসে পড়া রোদের দগদগে ক্ষত ঢাকতে
গিয়ে হাঁফাচ্ছে সর্বহারা
বিকলাঙ্গ একটি দিন
ঝুলে আছে ইলেক্ট্রিক শক খাওয়া কাকের মতোন
বেরিয়ে আসা জিভের ডগায় চলছে
অন্ধমাছিদের তুমুল উৎসব
ধারেকাছে আকাশ-বাতাসের নেই বিলাপ ।
নদনদী সাগর মহাসাগর উগরে দেয় শুধুই
রুপোলী মানুষ আর মানুষ
নারী পুরুষ বৃদ্ধ যুবা শিশু- নুলো অন্ধ
কালা রুগ্ন মোটা নাদুসনুদুস মানুষ
ক্রমে জনপদ হয়ে যায় মানুষময়, মানুষিক
জনপদে শুরু হয় হল্লাবাজির বিকট উৎসব
সর্বত্র ছড়িয়ে খুবলে নেয়া লাশ
বুক উপড়ানো থেতলানো যুবতী মাছ
ঘরে ঘরে নিরুদ্দিষ্টের লম্বা ফর্দ হিসহিসিয়ে হাসে পিশাচ
খিলখিল হাসে তল্লাটে।
লুট হয়ে যাওয়া দিনের মতো তুমিও নিরুদ্দেশ
হাপরের মতো নামে উঠে বুক
আগুন নেই একটুও
নেতিয়ে গেছে বলবান স্বপ্নের অদম্য সেই দ্রোহ
হার্মাদেরা জান্তব উল্লাস মগ্ন
বাধাহীন দুর্দমনীয়।
আলী সিদ্দিকীর এ যাবত প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ মোট ১৬টি।
গল্পঃ শঙ্খসোহাগ, রাজেশ্বরীর দায়, ঘোরবন্দী, অন্ধশিকার এবং নীলমনি। তাঁর উপন্যাসঃ প্রলম্বিত আঁধার এবং প্রতিপক্ষকাল।প্রবন্ধঃ আসুন, সত্যবাদীদের অভিনন্দন জানাই, তিমিরানন্দে বাংলাদেশ এবং পলিমাটির পাঁচালী কবিতাঃ মেঘদ্রোহী সূর্যসখাএবং মনোময়। কাব্যগ্রন্থ্ঃ ষষ্ঠশরের গীত, মায়াকাঞ্চন মালীর পৌরাণিক উনুন, মানুষই আহার্য, ধর্মাবতার এবং অন্তর্লোকেরআনাজপাতি।
আলী সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম শহরের রামপুর ওয়ার্ডে জন্মেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ায় বসবাস করছেন পরিবার নিয়েএবং একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত আছেন।
আজ আমাদের সকলের প্রিয় এই মানুষটির জন্মদিন। প্রথম আলো উত্তরের সাহিত্য-এর পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই প্রাণঢালাভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন আলী সিদ্দিকী।